ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের তাৎপর্য আলোচনা কর।

১৭ই এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের এক স্মৃতি বিজড়িত দিন।১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ নবাবের মসনদ হারানোর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি ২শ বছরের বৃটিশ ও পাকিস্তানি হায়েনাদের শাসন-শোষণ-নির্যাতনে শৃঙ্খলিত ছিল। 

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতার লাল সূর্যটি অস্তমিত হলেও ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পলাশীর প্রান্তর থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে মেহেরপুরের ভবের পাড়ার বৈদ্রনাথতলার আরেক আম্রকাননে বাংলার লাল সূর্যটি উদিত হয়েছিল। 


বাংলা, বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর যেন সমার্থক শব্দ এখন। একাত্তরের এ দিনে বাঙালি জাতি নতুন করে আবার জেগে ওঠে, মুছে দেয় পরাজয়ের গ্লানি। বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতীক্ষার পর অজ পাড়াগাঁয়ে রচিত হয়েছিল আরেকটি ইতিহাস। একাত্তরের অগ্নিঝরা এ দিনেই বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন সরকারের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিমূল রচিত হয়েছিল আম্রকাননে।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রান্ত বাঙালি জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।রচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস। রাতারাতিই বিশ্বের ইতিহাসে অখ্যাত বৈদ্যনাথতলাটি হয়ে ওঠে বিখ্যাত। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে ভূখণ্ডটি স্বীকৃতি পায় একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে। 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি থাকায় তার অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করে এ দিন গঠিত হয় অস্থায়ী সরকারের বিপ্লবী মন্ত্রিপরিষদ। আর সঙ্গে সঙ্গে এ বিপ্লবী মন্ত্রিপরিষদকে স্বীকৃতি দেয় বিশ্ব নেতারা।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকায় তার অনুপস্থিতে সে দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।সরকারের মন্ত্রিসভায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিশ্বাসঘাতক খোন্দকার মোস্তাক আহমেদকে আইন, বিচার ও পররাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী করা হয়। 

শপথ গ্রহণের পর পরই নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনই বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সরকার বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। ইয়াহিয়ার এ প্রচার মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের শপথগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের মাটিতে বসেই। 

পরবর্তীতে এই মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ও দক্ষ পরিচালনায় মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি নয় মাস মরণপণ লড়াই করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্যটি। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জত, বীর বাঙালির আত্মত্যাগে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন ও সার্বভোম একটি রাষ্ট্র- বাংলাদেশ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url