১৯৫৬ সালের সংবিধান ব্যর্থতার কারণ

১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করেন কে? ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ যে সংবিধান প্রণীত ও কার্যকর করা হয়েছিল তা মাত্র দু বছর আট মাসকান চালু ছিল। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক আইন জারি করেন এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ঘোষণা করেন।

১৯৫৬ সালের সংবিধান ব্যর্থতার কারণ

১. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি: সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তা সফল করে তোলার জন্য সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল বিকশিত না হওয়ায় এই সংবিধান কার্যকর হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পরিণত হয়েছিল মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের পকেট সংগঠনে। এছাড়া ছিল উপদলীয় কোন্দল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে দলটির ভাবমূর্তি দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম হলেও সরকারের ষড়যন্ত্র ও দমননীতির কারণে আওয়ামী লীগকে বিরোধীদলের স্বাভাবিক দায়িত্ব বা ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হয়নি।

২. দলীয় শৃঙ্খলার অভাব: সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সুকঠিন দলীয় শৃঙ্খলা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদের ষড়যন্ত্রে ও দলীয় নেতাদের নৈতিকতার অভাবে রাতারাতি দল বদলের খেলা চলছিল। ফলে সরকারের স্থায়িত্ব বিনষ্ট হচ্ছিল।

৩. দলীয় স্বার্থের প্রাধান্য: পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটি দলই বিশেষ করে মুসলিম লীগ এ সময় দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ অপেক্ষা ক্ষুদ্র দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখতে সচেষ্ট ছিলেন।

৪. উপনির্বাচন স্থগিত ঘোষণা: ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আইন পরিষদের শূন্য আসনগুলোতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানে গড়িমসি করতে থাকে।

৫. অহেতুক হস্তক্ষেপ: প্রথমাবধি পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা এবং আইন পরিষদের কাজে রাষ্ট্রপ্রধান অহেতুক হস্তক্ষেপ করায় সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি ও ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়। স্বয়ং মি. জিন্নাহ্ নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করতেন। গোলাম মুহাম্মদের সময় এই হস্তক্ষেপ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। গোলাম মুহাম্মদের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ প্রতিরোধের জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্যত হলে তিনি সংসদীয় রীতি-নীতি উপেক্ষা করে প্রথম গণপরিষদ ভেঙে দেন। এরূপ প্রবণতা পাকিস্তানের রাজনীতিতে শেষাবধি বিরাজমান ছিল।

৬. জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব: সংসদীয় গণতন্ত্রকে বাস্তবায়িত করার মতো শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনগোষ্ঠী তখনও বিকশিত হয়নি। সময়মত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে না ওঠায় জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়নি।

৭. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা লিপ্সা: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা লিপ্সার কারণে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রহসনে পরিণত হয়। ফলে এই সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সফল হতে পারেনি।


৮. সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহা: ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলের ক্ষমতার মোহ, দলটির দ্রুত ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়া এবং অন্যান্য কারণে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর নির্বাচন বিশেষ করে ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের ফলে তারা আর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেনি। ১৯৫৮-৫৯ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে কায়েমি স্বার্থবাদীরা পরাজিত হবে এবং সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে— এই ভয়ে দেশে দ্রুত সামরিক শাসন জারি করা হয়।

৯. সহনশীলতার অভাব: সহনশীলতা সংসদীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু এই সংবিধান কার্যকর থাকাকালীন সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীলতার অভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর উপর শারীরিক নির্যাতন সহনশীলতার অভাবেরই বাস্তব ফলশ্রুতি।

১০. বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব হ্রাস: ১৯৫৬ সালের সংবিধান ব্যর্থতার কারণ অন্যতম কারণ হলো জাতীয় পরিষদে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব হ্রাস করা।

১১. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন: প্রদেশগুলিকে কোন প্রকার স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয় নি। যার ফলে ১৯৫৬ সালের সংবিধান ব্যর্থ হয়েছিল।

১২. সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সেনাবাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধান ব্যর্থ হয়েছিল।

১৩. সংবিধান কমিশনের মত: সংবিধান কমিশন ১৯৬০ সালে তাঁদের রিপোর্টে বলেছিলেন যে,
  • (১) সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাব,
  • (২) সংবিধানের অন্তর্নিহিত ত্রুটি-বিচ্যুতি,
  • (৩) রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক মন্ত্রিসভার কার্যক্রমে অহেতুক হস্তক্ষেপ,
  • (৪) রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতি প্রভৃতি ছিল ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url