অস্তিত্ববাদ কি? অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য, পটভূমি ও মূল্যায়ন
অস্তিত্ববাদ কাকে বলে
অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞা: যে মতবাদ মানবজীবনকে সম্ভবপর করে তোলে এবং যে মতবাদ অনুযায়ী প্রতিটি সত্য এবং কর্মপরিবেশ মানুষের আত্মীকতা সকলকে বোঝায়। অস্তিত্ব শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Exist এটি ল্যাটিন শব্দ Existenz থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ দাঁড়ায় Stand out বা ব্যক্তির অন্তরের বিচিত্র ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। জ্যা পল সার্ত্রের মতে, অস্তিত্ব সবসময় সারধর্মের পুরোগামী। তিনি আরও বলেন যে, আত্মীকতা অস্তিত্ববাদের প্রারম্ভিক সূত্র। সে আত্মীকতা অবশ্য ভাববাদী আত্মীকতা থেকে ভিন্ন। অস্তিত্ববাদ হলো এমন একটি দার্শনিক আন্দোলন যা ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করে। সার্ত্র মনে করেন যে, অস্তিত্বের মধ্যে অন্তর্বিরোধ রয়েছে।
হাইডেগার অস্তিত্ব শব্দটি তিন প্রতিশব্দে ব্যবহার করেছেন। প্রথমত, Dasein এ শব্দের দ্বারা তিনি শুধুমাত্র মানুষের অস্তিত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন। দ্বিতীয়ত, Vorhandenheit শব্দটি দ্বারা প্রাণীর অস্তিত্ব এবং সর্বশেষ Existenz শব্দটি দ্বারা শুধুমাত্র মানবসত্তার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতে পারে এবং এটাই ব্যক্তি সত্তার অনাবশ্যক বৈশিষ্ট্য। অস্তিত্ববাদ সংক্রান্ত দর্শনে এ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত ব্যক্তি সত্তাকেই বোঝানো হয়েছে। মোটকথা, অস্তিত্ববাদী দর্শনে, সকল প্রাণী, মানুষ ও বস্তু সংবলিত জগতের পটভূমিকায় ব্যক্তি বিশেষের অস্তিত্ব উপস্থিত হয়েছে। এজন্য অস্তিত্ববান ব্যক্তিসত্তাও হতে পারে।
কার্ল জেসপার্স এর মতে, Existenz শব্দের অর্থ প্রকৃত সত্তা নয়; এ হলো সুপ্ত সত্তা। এর অর্থ হলো আমি প্রকৃত সত্তা নই, আমি সম্ভাব্য সত্তা। আমার যথার্থ স্বরূপ আমার মধ্যে প্রদত্ত নয়। আমাকে তা অর্জন করে নিতে হবে।
Wikipedia তে অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে "In existentialism meaning is understood as the worth of life meaning in existentialism is descriptive therefore it is unlike typical, prescriptive conception of the meaning of life. "
অবশেষ বলা যায় যে, কোনো মানুষই পরিণত সত্তা নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। সুপ্ত সত্তার বাস্তব রূপায়ণ ঘটিয়ে অস্তিত্বশীল সত্তার রূপায়ণ করতে হয়।
অস্তিত্ববাদের ঐতিহাসিক পটভূমি
অস্তিত্ববাদের উদ্ভব: অস্তিত্ববাদী দর্শনের উৎপত্তি হচ্ছে এক ঐতিহাসিক পটভূমিকায়। আধুনিক যুগ হলো যান্ত্রিক সভ্যতার যুগ। চারদিকে শুধু বিজ্ঞান প্রযুক্তির জয়গান। প্রযুক্তি বিদ্যা প্রভুত্ব বিস্তার করেছে। মানুষের উপর মানুষ হয়েছে যন্ত্রের ক্রীতদাস। যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে মানুষের জীবনে বিরাট শূন্যতা এসেছে। যন্ত্রের উপরই যেন তার সব অস্তিত্ব নির্ভরশীল। ইতিহাসের দুটো ভয়ংকর যুদ্ধ মানব সভ্যতার ইতিহাসকে চিরতরে কলঙ্কিত করে রেখেছে। যুদ্ধের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড,বিভীষিকা ও ভয়াবহতার কালো মূর্তি আজও সভ্য মানুষের দেহে শিহরণ জাগায়। সার্ত্র, হাইডেগার প্রমুখ দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লক্ষ্য করেছেন এসব। নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী শক্তির কাছে শত শত মানুষ অত্যাচারিত ও পদদলিত হয়েছে। নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুর জীবন নিশ্চিহ্ন হয়েছে। নাগাসাকি ও হিরোশিমা কিভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বংস হয়েছে। মহাযুদ্ধের এসব বিভীষিকাময় তাণ্ডবলীলা অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মনে নিদারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মানুষ যখন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে যুদ্ধের ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চোখের সামনে দেখে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের নির্মম মৃত্যু তখন নিজের অস্তিত্ব ছাড়া আর কি মূল্যবান হতে পারে।
অস্তিত্ববাদীদের মতে, মানুষের অস্তিত্বই মূল। সক্রেটিস, প্লেটো, হেগেল, কার্ল মার্কস প্রমুখ দার্শনিকরা সার্বিক অস্তিত্ববাদ বা সার্বিক সত্তাকে সব জিনিসের ব্যাখ্যাসহ অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্লেটোর দর্শনে মানুষেরর বাস্তব অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ আগ্রাহ্য করে সবার ঊর্ধ্বে মূল্য দিয়েছেন সার্বিক ধারণাকে এবং দৃশ্যমান জগতের সবকিছু অবাস্তব ও অসত্য বলে বর্জন করে সার্বিক ধারণাকে চূড়ান্ত রূপে চিহ্নিত করেছেন। কার্ল মার্কসের দর্শনেও ব্যক্তিসত্তার কোনো স্থান নেই, আছে সার্বিক অস্তিত্বের। অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা এসবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
অস্তিত্ববাদীদের মতে, দর্শন অবাস্তব, বিমূর্ত বা কাল্পনিক কোনোকিছু সম্বন্ধে চিন্তার নয়, দর্শন হলো জীবনের পথ, বাঁচার পথ।
মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করার এক বলিষ্ঠ দার্শনিক প্রচেষ্টা হলো অস্তিত্ববাদ। মানুষের অস্তিত্ব, ব্যক্তি-সত্তা, স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতি অবহেলার প্রতিবাদস্বরূপ জন্ম নিয়েছে অস্তিত্ববাদের। অস্তিত্ববাদই বিপ্লবী দর্শন এবং বিপ্লব ঘোষিত হয়েছে অস্তিত্ববাদের। যে কোনো মতবাদের বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেখানে ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব অবহেলিত হয়েছে বা তাঁর স্বাধীনতা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ
অস্তিত্ববাদ সাম্প্রতিক দর্শন ও সাহিত্যের একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী মতবাদ। মানুষের জীবনের বহুমুখী সমস্যা থেকেই এই দর্শনের উৎপত্তি। তাই এটি একটি জীবন দর্শন। অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল আলোচনা হলো ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে। জ্যাঁ পল সার্ত্রেকে অস্তিত্ববাদী দর্শনের জনক বলা হয়।
অস্তিত্ববাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য: নিম্নে অস্তিত্ববাদের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. মানবতাবাদী মতবাদ : অস্তিত্ববাদকে মানবতাবাদী মতবাদ বলা হয়। অস্তিত্ববাদের মূল লক্ষ্য হলো মানবজাতির কল্যাণসাধন। তাই অস্তিত্ববাদ একটি মানবতাবাদী মতবাদ।
২. ব্যক্তিবাদী মতবাদ : অস্তিত্ববাদ হলো একটি ব্যক্তিবাদী মতবাদ। এ মতামত ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। অস্তিত্ববাদী দর্শনের মতো অন্য কোনো মতবাদে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি এত বেশি জোর দেয়া হয়নি। এটি মানুষের স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতন করে এবং মানুষের অস্তিত্বের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে।
৩. ভাববাদ বিরোধী মতবাদ : অস্তিত্ববাদকে ভাববাদ বিরোধী মতবাদ বলা হয়। হেগেলের ভাববাদের বিপরীতে এই মতবাদের উদ্ভব হয়। অস্তিত্ববাদের মাধ্যমে পূর্ববর্তী ভাববাদীদের সারসত্তাকে খণ্ডন করা হয়।
৪. ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব : অস্তিত্ববাদ ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করে। এ মতবাদে সাধারণ মানুষের কোনো আলোচনা করা হয় না। এই দর্শন আলোচনা করে বিশেষ ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব নিয়ে।
৫. আবেগধর্মী মতবাদ : অস্তিবাদ একটি আবেগধর্মী মতবাদ। এই মতবাদে মানুষের আবেগ সম্পর্কে উপস্থাপন করা হয়। মানুষের বহুমুখী সম্ভাবনা ও অপূর্ণতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
৬. জীবনদর্শন : অস্তিত্ববাদ একটি জীবন দর্শন। এখানে মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সবকিছুই উপস্থিত আছে। মানুষের জীবনের বাস্তব সমস্যা সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়।
অস্তিত্ববাদে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটি নিদর্শন। এখানে বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাই এই অস্তিত্ববাদী দর্শনকে মানবতাবাদী দর্শন বলা হয়।
অস্তিত্ববাদের মূল্যায়ন
অস্তিত্ববাদের মূল বক্তব্য: অস্তিত্ববাদ সম্প্রতিক দর্শন ও সাহিত্যে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী মতবাদ। মানুষের জীবনের বিভিন্ন সমস্যা থেকে এই দর্শনের উৎপত্তি। এই দর্শনের মূল্য আলোচ্যবিষয় ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব। অস্তিত্ববাদের প্রথম প্রবক্তা কে? সোরেন কিয়ার্কেগার্ড অস্তিত্ববাদের জনক হিসাবে পরিচিত। অস্তিত্ববাদের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন জ্যাঁ পল সার্ত্রে। তিনি অস্তিত্ববাদ প্রচার করতে নিজের অভিমত উপস্থাপন করেছেন যা অস্তিত্ববাদকে বিকশিত করেছে।
অস্তিত্ববাদীদের মতে, মানুষ হলো চেতনার মূর্ত প্রতীক। যা মানুষকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে সহায়তা করে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানুষ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সব সমস্যা অতিক্রম করে মানুষকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হয়। অস্তিত্ববাদে এরূপ প্রতিবন্ধকতার কথা উপস্থাপন করা হয়েছে।
অস্তিত্ববাদের সমালোচনা : অস্তিত্ববাদকে অনেকে আত্মকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পৃষ্ঠপোষক বলে অভিহিত করেন। অস্তিত্ববাদে মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে বেশি আলোচনা করা হয়। এখানে জাতি, গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে উপস্থাপন করা হয়নি। পেটন বলেন, “আত্মকেন্দ্রিক মানুষ যদি কেউ থেকে থাকেন, তবে তিনি কিয়ের্কেগার্ডে তিনি নিজের কথা ছাড়া অপরের কথা কদাচিৎ ভাবতে পারেন।"
অস্তিত্ববাদ কেবল মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে তাই এর দার্শনিক সামগ্রিকতা বিনষ্ট হয়। কারণ দর্শনের আলোচ্যবিষয় হলো সমগ্র বিশ্বজগৎ। কিন্তু অস্তিত্ববাদীরা অস্তিত্ববানকে মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে।
অনেকে অস্তিত্ববাদকে নৈরাশ্যবাদী ও নিঃসঙ্গতার দর্শন বলে সমালোচনা করেছেন। কেননা এখানে বাস্তব জীবনের দুঃখ-দুর্দশা ও নিরাশার কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অস্তিত্ববাদে সত্তার স্বরূপ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অস্পটতার পরিচয় দিয়েছে। এখানে বিমূর্ত সত্তাকে অস্বীকার করেছেন। তারা সত্তা বলতে মূর্ত সত্তাকে বুঝিয়েছেন।
এখানে ঈশ্বরের ধারণা অনুপস্থিত। তাই মানুষই নৈতিকতার সৃষ্টিকারী। মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন তাই মানুষই ভালো-মন্দের নির্ধারণকারী।
অস্তিত্ববাদ মূলত মানুষের বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করে। এখানে বিশ্ব জগতের ধারণা অনুপস্থিত। এখানে ব্যক্তি বিশেষের অস্তিত্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়। তাই অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদ অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।