১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণ আলোচনা কর।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে নব প্রবর্তিত সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এ সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কার্যকরী হতে না পাওয়ায় এক অস্থিতিশীল শাসন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ১৯৫৮ সালের এ শাসনতান্ত্রিক অস্থিতিশীলতা লক্ষ্য করে সমকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তাই শাসনব্যবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন এবং সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জেনারেল আইয়ুব খানকে CMLA নিযুক্ত করেন।

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির কারণ 

প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা তার নিজ ঘোষণায় সামরিক শাসন জারির ইঙ্গিত দেন। তিনি ঘোষণায় বলেছেন, "(There was ) reithless struggle for power, corruption, the shameful exploitation of the simple, honest, patriotic and industrious masses, the lack of decorum and the prostitution of Islam for political ends. " (Government Press note Reprinted in The New York Times, October 8, 1958)। 

নিম্নে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণগুলো আলোচনা করা হলোঃ

১. সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি: প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির জন্য সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। কারণ ঐ মুহূর্তে সামরিক শাসন ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সাধ্যের বাইরে ছিল।

২. গণতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতা: পাকিস্তানের ১৯৪৭ সাল থেকে প্রায় একদশক যে গণতান্ত্রিক শাসন প্রচলিত ছিল তা সমস্যা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে ১৯৫৭ সালের দিকে গণতান্ত্রিক সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়। তাই প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে সামরিক শাসন প্রবর্তন করেন ।

৩. সংবিধান অকার্যকর হওয়া: পাকিস্তানের সাংবিধানিক স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ১৯৫৬ সালে সংবিধান কার্যকরী হতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানের ৫৬ সালের সংবিধানের ব্যর্থতা গণতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতাকে ফুটিয়ে তুলেছিল। তাই ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক শাসন প্রবর্তন করেন।

৪. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে চরম বিভেদ: ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ এর পূর্বাবধি পাকিস্তানে কোন সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেনি। সমকালীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বদানের মত যোগ্য নেতার যথেষ্ট অভাব অনুভূত হয়। তাই মুসলিম লীগ যেমন চক্রান্তকারী মহলের খপ্পরে পড়েছিল, তেমনি আওয়ামী লীগকে চারদিক থেকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল।

৫. দলীয় শৃঙ্খলার অভাব: সমকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলাবোধের যথেষ্ট অভাব ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো যে কোনো বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে ব্যর্থ হওয়ায় গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনকার্য পরিচালনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের সমকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত হীনতার ফলে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার হস্তক্ষেপে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়।


৬. নির্বাচনের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া: ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানের বিবদমান পরিস্থিতির উন্নতির জন্য নতুন নির্বাচনের কথা বলা হয়। কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন হবে না উপলব্ধি করে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা গণতান্ত্রিক শাসনের স্থলে সামরিক শাসনের প্রবর্তন করেন।

৭. আইনসভায় অপ্রীতিকর ঘটনা: ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আইনপরিষদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্যে বৈঠক চলাকালে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তিন দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এমনি অবস্থায় গণতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়।

৮. ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন: ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে একাধিক সরকার গঠিত হয়েছিল। ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পদত্যাগের পর আই. আই. চন্ডীগড় রিপাবলিকান পার্টির সমর্থন নিয়ে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করেন। এ সরকার দু'মাসেরও কম সময় স্থায়ী হয়। এরপর আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ফিরোজ খান নূন সরকার গঠন করেন (১৬ ডিসেম্বর ৫৭)। এভাবে একাধিক সরকার গঠিত হওয়াও গণতান্ত্রিক শাসনের ব্যর্থতার দিকটাকে স্পষ্ট করে তুলেছিল।

৯. জাতীয়তাভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। গণতান্ত্রিক সরকার মাত্রই দলীয় সরকার। সংসদীয় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তা অধিকতর প্রযোজ্য। রাজনৈতিক দল জাতীয় সংহতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু পাকিস্তানে সমকালীন অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের দলের একান্ত অভাব দেখা দেয়। পাকিস্তানের যে মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগ নামে দু'টি দল ছিল তা স্বার্থ দ্বন্দ্বের কারণে দুর্বল হয়ে যায়।

১০. মন্ত্রিসভার দ্রুত রদবদল: পাকিস্তানে ১৯৫১-১৯৫৮ সালের মধ্যে কেন্দ্রে ৭টি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সামরিকবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। এ সময় কোন কোন প্রদেশে সরকার অনুরূপ অস্থিতিশীল ছিল। পাকিস্তানের সমকালীন রাজনৈতিক অবস্থা এত অস্থিতিশীল ছিল যে, একটি সরকার মাত্র ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সোহরাওয়ার্দীর মত দক্ষ, প্রজ্ঞা ও প্রবীণ রাজনীতিজ্ঞ কেন্দ্রে মাত্র ১৩ মাস ক্ষমতাসীন ছিলেন। এ ধরনের অবস্থা সামরিক সরকার কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণের পথকে সুগম করেছিল।

১১. আমলাদের দৌরাত্ম্য: পাকিস্তানে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে এক দশকে আমলাদের দৌরাত্ম্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তবে এ আমলাদের হস্তক্ষেপ পাকিস্তানে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বিরাজমান ছিল। গোলাম মোহাম্মদ, ইস্কান্দার মীর্জা, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, জেনারেল আইয়ুব সকলে হয় আমলা না হয় সামরিকবাহিনীর সদস্য ছিলেন। আর এদের অঘোষিত হস্তক্ষেপের ফলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যর্থ হয়। আর গণতান্ত্রিক শাসনের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে সামরিক শাসন চালু হয়।

১২. বাঙালি ও পাঞ্জাবি দ্বন্দ্ব: পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান, জাতিগত ভিন্নতা বাঙালি বনাম পাঞ্জাবি দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছিল। এ দ্বন্দ্বের ফলে গণতান্ত্রিক শাসন কার্যকরী হতে ব্যর্থ হয়। এ দ্বন্দ্বের অবসান না হওয়ায় পাকিস্তানি সামরিকবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ কোন অমূলক ঘটনা ছিল না।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পাকিস্তান সৃষ্টি থেকেই নানা অনৈক্য সৃষ্টি হয়। যার ফলে সামরিক হস্তক্ষেপ আবশ্যক হয়ে পড়ে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url