১৯৫৬ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ রোগাক্রান্ত ও মস্তিষ্কের ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় অবসর গ্রহণে বাধ্য হলে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ এবং শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট (আওয়ামী লীগ ব্যতীত) কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। এর ফলে ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পদত্যাগ করলে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় গণপরিষদ সংবিধান রচনার কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। 'মারী চুক্তির আলোকে ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশকে একত্রিত করে একটি প্রদেশ গঠন করা হয়। ১৯৫৬ সালের ৮ জানুয়ারি দ্বিতীয় গণপরিষদে 'পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সংবিধান বিল' উত্থাপন করা হয়। বিলটি ২১ জানুয়ারি গণপরিষদে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয় এবং ২ মার্চ গভর্নর জেনারেল এই বিলে সম্মতি প্রদান করে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধান ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে কার্যকরী করা হয়।

১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য 

পাকিস্তান সৃষ্টির দীর্ঘ দশ বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় গণপরিষদ কর্তৃক পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের খসড়া গৃহীত হয়। এই সংবিধান ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে তা কার্যকর হয়। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ :

১. ইসলামী প্রজাতন্ত্র : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে একটি 'ইসলামী প্রজাতন্ত্র' বলে আখ্যায়িত করা হয়। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোন আইন প্রণীত হবে না বলে উল্লেখ করা হয়। ইসলামী সমাজব্যবস্থা গঠনের উদ্দেশ্যে ইসলামী গবেষণাগার ও ইসলামী উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। সংবিধানে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলমান।

২. লিখিত সংবিধান : ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধান ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম লিখিত সংবিধান। ১০৫ পৃষ্ঠায় এই সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা, ১৩টি অংশ, ৬টি তালিকা ও ২৩৪টি ধারা সন্নিবেশিত ছিল।

৩. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানঃ এই সংবিধান ছিল দুষ্পরিবর্তনীয়। জাতীয় পরিষদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সংশোধনী বিল উত্থাপন করা গেলেও তা পাস করতে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হত।

৪. প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র: ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী সর্বজনীন ভোটাধিকার নীতির ভিত্তিতে জাতি-ধর্ম বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটে সরকার গঠিত হত।

৫. যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার: এই সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। সংবিধান কর্তৃক ক্ষমতা বণ্টননীতি, যুক্তরাষ্ট্রীয় আনাগত এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।

৬. সংসদীয় সরকার : এই সংবিধান কেন্দ্র ও প্রদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করে আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রিসভা গঠন করত এবং তাদের কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকত।


৭. মৌলিক অধিকার: সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ সন্নিবেশিত হয়। মৌলিক অধিকারগুলোকে আদালতের আওতাভুক্ত করা হয়, তবে জরুরি অবস্থা চলাকালে রাষ্ট্রপতি মৌলিক অধিকার রহিত করতে পারতেন।

৮. রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্দেশক নীতি: আয়ারল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি দেশের ন্যায় এই সংবিধানে কতগুলো 'রাষ্ট্রীয় নীতি নির্দেশক নীতি' বা আদর্শ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

৯. এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা : এই সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য কেন্দ্র ও প্রদেশে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের ব্যবস্থা করা হয়।

১০. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত : কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সম্ভাব্য বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত গঠন করা হয়। সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান এবং সংসদীয় যেকোন আইনকে সংবিধানসম্মত নয় বলে ঘোষণা করার ক্ষমতা এই আদালতে প্রদান করা হয়।

১১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : এই সংবিধানে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক রাখা হয় এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়।

১২. সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা : এই সংবিধানে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url