ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর।

ক্যাবিনেট ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার একটি বিশেষ দিক। ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সাংবিধানিক ভাবে ক্যাবিনেট হল দায়িত্বশীল শাসন বিভাগ, যার হাতে প্রশাসনের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় দায়িত্ব পালনের জন্য সকল নির্দেশ দানের ক্ষমতা ন্যস্ত। বেজইট বলেন, "The Cabinet is the keystone of the political arch.” ক্যাবিনেট মন্ত্রীমন্ডলীর চেয়ে কম সংখ্যক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। সব ক্যাবিনেট সদস্যই মন্ত্রী, কিন্তু সব মন্ত্রী ক্যাবিনেট সদস্য নন। ক্যাবিনেট হল এমনই এক ব্যবস্থা যেখানে বিশেষ ক্ষমতাবান ও আস্থাভাজন মন্ত্রীগণ অন্তর্ভুক্ত। ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থার দীর্ঘ পরিক্রমার ফল। সপ্তদশ থেকে বিংশ শতাব্দী-এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ক্যাবিনেট ব্যবস্থার উদ্ভব। দ্বিতীয় চার্লস কাউন্সিলের ৫ জন সদস্য নিয়ে এই ক্যাবিনেট প্রথম গঠিত হয়। 


রবার্ট ওয়ালপোল ক্যাবিনেট ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলো নির্ধারণ করেন। ক্যাবিনেটের প্রথম পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে রাজা তৃতীয় জর্জের আমলে । এসময় উইলিয়াম পিট প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ক্যাবিনেট ব্যবস্থার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কায়েম করেন।

ব্রিটিশ ক্যাবিনেট ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

ব্রিটেনে ক্যাবিনেট ব্যবস্থা বিদ্যমান। ক্যাবিনেট ব্যবস্থার কতিপয় বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এগুলো হলঃ

১. আনুষ্ঠানিক শাসক প্রধান: ব্রিটেনের ক্যাবিনেট ব্যবস্থা শাসক প্রধান। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার শীর্ষে আছেন রাজা বা রানী। কিন্তু তিনি নাম মাত্র শাসক। শাসন কার্যের সব ক্ষমতা ক্যাবিনেটের উপর ন্যাস্ত। ক্যাবিনেট সভায় রাজা বা রানী উপস্থিত থাকেন না। প্রধানমন্ত্রীই এ সভার দায়িত্ব পালন করেন।

২. পার্লামেন্টের সদস্য: ক্যাবিনেট সদস্যরা পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্যাবিনেট সদস্য হতে হলে আগে তাকে পার্লামেন্টের সদস্য হতে হয়। পার্লামেন্টের সদস্য না হয়ে কোন ব্যক্তি ক্যাবিনেটের সদস্য হতে পারেন না। প্রথমে কোন ব্যক্তি ক্যাবিনেট সদস্য হতে পারেন। কিন্তু ছ'মাসের মধ্যে তাকে পার্লামেন্টের সদস্য হতে হয়।

৩. ঘনিষ্ঠতা: ঘনিষ্ঠতা ক্যাবিনেটের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় ক্যাবিনেট ও পার্লামেন্টের মধ্য ঘনিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রত্যেক মন্ত্রীকেই পার্লামেন্টের যে কোন কক্ষের সদস্য হতে হয়। পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ক্যাবিনেট সদস্যরাই পরিচালনা করেন। ফলে সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

৪. দায়িত্বশীলতা: দায়িত্বশীলতা ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের একটি বিশেষ দিক। ক্যাবিনেট সদস্যগণ রাজনৈতিক দিক থেকে কমন্স সভার কাছে দায়ী। তাঁরা যৌথভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের কাজ কর্মের জন্য কমন্সসভার কাছে দায়ী থাকেন। প্রত্যেক সদস্যই তার স্ব-স্ব দাপ্তরিক কাজের জন্য কমন্স সভায় কৈফিয়ত দিতে বাধ্য।

৫. সংখ্যাগরিষ্ঠ নীতি: সংখ্যাগরিষ্ঠ নীতি ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের একটি বিশেষ দিক। ক্যাবিনেট গঠনের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নিয়ে ক্যাবিনেট গঠন করা হয়। কমন্স সভায় সংখ্যাগরিষ্ট দলই ক্যাবিনেট গঠন করে। ঐ দলের নেতাকে রাজা বা রানী মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী ক্যাবিনেট সদস্য নিযুক্ত করেন। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও আস্থাভাজন নীতি অনুসৃত হয়।

৬. প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ : ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়। প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেট গঠনে নিয়ন্ত্রণ করেন। ব্রিটিশ কেবিনেটের সাধারণ সদস্য হল ১৬ থেকে ২৪ জন। ১৯৮৪ সালে মার্গারেট থ্যাচারের ক্যাবিনেটের সদস্য সংখ্যা ছিল ২১ জন। সেতু বন্ধন ঃ ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের অন্যতম দিক হল সেতু বন্ধন। ব্রিটিশ ক্যাবিনেট আইন বিভাগ ও শাসন-বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি অনুসৃত হয়। ফলে শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে সু-সম্পর্ক বজায় থাকে।

৭. দলীয় শাসন ব্যবস্থা: ক্যাবিনেট ব্যবস্থা মানেই দলীয় ব্যবস্থা। ব্রিটেনের ক্যাবিনেট ব্যবস্থাও এর বাইরে নয়। ব্রিটেনের ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থা হল মূলতঃ দলীয় শাসন ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে রামসে ম্যুর (Ramsy Muir) বলেন, “Party spirit supplies the driving force of the whole machine"।

৮. সংহতি: ব্রিটেনে ক্যাবিনেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সুদৃঢ় ঐক্য। কমন্স সভার কাছে যৌথ দায়িত্বশীলতার কারণে মন্ত্রীদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি আবশ্যক। ক্যাবিনেট সদস্যের মধ্যে ঐক্য না থাকলে শাসন কার্য ব্যহত হয়। এ কারণেই ব্রিটেনের ক্যাবিনেট সভায় ঐক্য ও সংহতি বিদ্যমান।

৯. আস্থাশীলতা: আস্থাশীলতা ব্রিটেন ক্যাবিনেটের একটি অন্যতম ভিত্তি। কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই ব্রিটেনের রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ক্যাবিনেটের কার্যকাল কমন্স সভার উপর ন্যস্ত। এ কারণে ক্যাবিনেটকে কমন্স সভার উপর আস্থাশীল হতে হয়।

১০. বিরোধী দলের অস্তিত্ব: ব্রিটেনের কমন্স সভায় বিরোধী দলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এ বিরোধী দল শক্তিশালী হয়ে থাকে। বিরোধী দল ক্যাবিনেটের বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। বিরোধী দল সরকারী কাজ কর্মের বিরোধীতা ও সমালোচনা করে। তারা সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে জনগণের সামনে তুলে ধরে।

১১. শাসনতান্ত্রিক রীতি-নীতি: শাসনতান্ত্রিক রীতি নীতির প্রাধান্য ব্রিটেন ক্যাবিনেটে লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটেনের ক্যাবিনেট শাসনতান্ত্রিক প্রথার উপর নির্ভরশীল। এর কোন আইনগত ভিত্তি নাই। পেশাগত ভাবে ক্যাবিনেট ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। এ রীতি নীতির ভিত্তিতে ক্যাবিনেট শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত। এ ক্যাবিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলী প্রথা দ্বারা নির্ধারিত।

ব্রিটিশ ক্যাবিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলী

ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার মধ্যমণি হল ক্যাবিনেট। এই ক্যাবিনেটের প্রধান হলো প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নিয়ন্ত্রণে ক্যাবিনেটের যাবতীয় কার্যাবলী পরিচালিত। এ ব্যবস্থায় রাজা বা রানীর ভূমিকা গৌন। রাজা বা রানী ক্যাবিনেট নেতাকে নিযুক্ত করেন। ক্যাবিনেটের ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

১. নীতি নির্ধারণ: ব্রিটেনের ক্যাবিনেটের প্রথম ও প্রধান কাজ হল নীতি নির্ধারণ। শাসন ব্যবস্থার মৌলিক নীতিগুলো ক্যাবিনেট নির্ধারণ করে। ক্যাবিনেট ব্রিটেনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের পক্ষে নীতি নির্ধারণ করে। পররাষ্ট্র, যুদ্ধ ও শান্তি সম্পর্কিত চুক্তি ও বৈদেশিক বাণিজ্য ক্যাবিনেটের দ্বারা নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দপ্তরের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা ক্যাবিনেটকে সাহায্য করে।

২. আইন প্রণয়ন: আইন প্রণয়ন পার্লামেন্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সরকারী নীতি নির্ধারণের সঙ্গে আইন প্রণয়নের ব্যাপারটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারী নীতিগুলো আইনের দ্বারা বাস্তবায়িত হয়। ক্যাবিনেট আইনের খসড়া তৈরি করে। অবশ্য এক্ষেত্রে ক্যাবিনেট পার্লামেন্টের সাথে পরামর্শ করে থাকে। ক্যাবিনেটের পিছনে সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থন থাকে। এ কারণে ক্যাবিনেটের প্রস্তাবগুলো সহজেই পাস হয়।

৩. পার্লামেন্ট সংক্রান্ত কাজ : ব্রিটেনে ক্যাবিনেট কিছু কিছু পার্লামেন্ট সংক্রান্ত কাজও করে থাকে। পার্লামেন্টের কর্মসূচী প্রণয়নে ব্রিটেন ক্যাবিনেটের ভূমিকা অপরিসীম। পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত ও ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষমতা মূলত রাজা বা রানীর উপর ন্যস্ত। রাজার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে ক্যাবিনেট সভা। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ক্যাবিনেট সভা ক্ষমতা প্রয়োগ করে। পার্লামেন্ট অধিবেশনে কোন কোন বিল উত্থাপন করা হবে তা ক্যাবিনেট নির্ধারণ করে। বর্তমানে বিভিন্ন দিক দৃষ্টকোণ থেকে ক্যাবিনেট পার্লামেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৪. শাসন সংক্রান্ত: শাসন সংক্রান্ত কাজ ব্রিটেনের পার্লামেন্টের একটি মৌলিক কাজ। ক্যাবিনেটকে কেন্দ্র করেই ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থা আবর্তিত। এ বিষয়েও রাজা বা রানী আইনতঃ ক্ষমতার মালিক। বাস্তব ক্ষেত্রে ক্যাবিনেটই সামিগ্রকভাবে শাসন বিভাগ পরিচালনা করে। রাজা বা রানীর নামে ক্যাবিনেট শাসন করে। পার্লামেন্টের আইন যাতে বাস্তবে প্রয়োগ করা যায় ক্যাবিনেট সে দিকে যথার্থ দৃষ্টি রাখে। মূলতঃ ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হল ক্যাবিনেট সভা।

৫. বাজেট সংক্রান্ত কাজ: এটি ক্যাবিনেটের একটি বিশেষ কাজ। সরকারের আয়-ব্যয় সংক্রান্ত কাজই বাজেটের অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে ক্যাবিনেটের ভূমিকা অপরিসীম। রাজস্ব বিভাগের চ্যান্সেলরের হাতে বাজেটের যাবতীয় কাজ ন্যস্ত। তবে এ ক্ষেত্রে অর্থ-মন্ত্রীই বাজেট তৈরী করেন। তিনিই কমন্স সভায় পেশ করেন। তবে আগে তিনি ক্যাবিনেটের সাথে পরমর্শ করে নেন। ক্যাবিনেটের আলোচনার পরই বাজেট চূড়ান্ত হয়। এ ব্যাপরে ক্যাবিনেট যৌথ দায়িত্বশীলতা ও গোপনীয়তার নীতি অনুসরণ করে।

৬. পররাষ্ট্র সংক্রান্ত কাজ : ব্রিটেনের পার্লামেন্টের একটি অন্যতম কাজ হল পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজ। ক্যাবিনেট আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে। যুদ্ধ, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক কাজ ক্যাবিনেটের নামে পরিচালিত হয়। বিশেষ করে বৈদেশিক চুক্তি ক্যাবিনেটের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে ক্যাবিনেট ও রাজা বা রানীকে পরামর্শ দিয়ে থাকে।

৭. অন্যান্য: উল্লেখিত কার্যাবলী ছাড়াও ব্রিটেনে ক্যাবিনেট কিছু অন্যান্য কাজও করে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে কোন জরুরি অবস্থা দেখা দিলে ক্যাবিনেট রাজা বা রানীকে পরামর্শ দেয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোন আকস্মিক ঘটনা ঘটলে ক্যাবিনেট সে বিষয়ে সত্তর ব্যবস্থা নেয়। এছাড়া ক্যাবিনেট রাজার বিশেষ অধিকার আছে কিনা তা লক্ষ্য রাখে। ডোমিনিয়ন-গভর্নর জেনারেল নিয়োগ ক্যাবিনেটের মাধ্যমে হয়। রাষ্ট্রদূত, বাণিজ্যিক প্রতিনিধি নিয়োগের মূল দায়িত্ব ক্যাবিনেটের উপর ন্যাস্ত।

শেষকথা: ক্যাবিনেট হল ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি । এটি ব্রিটেনে সংসদীয় ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মূলত রাজা দ্বিতীয় চার্লসের শাসনামলে ক্যাবিনেট ব্যবস্থার উৎপত্তি লক্ষ্য করা যায়। এ ব্যবস্থার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ অষ্টাদশ শতাব্দীতে লক্ষ্য করা যায়। দিনে দিনে ক্যাবিনেটের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে শাসন বিভাগীয় শক্তি ক্যাবিনেটের মাধ্যমে প্রয়োগ হচ্ছে। শাসন বিভাগীয় শক্তি ক্যাবিনেটের মাধ্যমে আইনসভা ও নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগ স্থাপন করছে। ফলে ব্রিটেনে ক্যাবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url