ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ কি?
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র সমগ্র ইউরোপের একটি পরিচিত প্রতিষ্ঠান। যে ব্যবস্থায় রাজা বা রানী বংশানুক্রমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। A. C. Kapur-এর ভাষায়, “In the course of history, those power have been almost entirely transferred from the kings as a person to a complicated impersonal organization called the Crown”. রাজতন্ত্রের শুরুর দিকে রাজা চরম ও স্বৈরাচারী ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। রাজাদের ব্যক্তিগত অভিরুচি অনুসারে ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হত। ঐ সময় রাজার 'ব্যক্তিগত ভূমিকার' প্রতিষ্ঠানগত রাজতন্ত্রের কোন পার্থক্য ছিল না। রাজা বা রানীর প্রতিষ্ঠানিক রাজপ্রতিষ্ঠান। এটা ব্যক্তি রাজা বা ব্যক্তি রানীর মৃত্যুতে বিলুপ্ত হয় না।
ছবি: সংগৃহীত |
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণ
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র একদিনে গড়ে উঠেনি। ধীরে ধীরে প্রথাগত বিধানের দ্বারা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়ের প্রেক্ষিতে ব্রিটেনের রাজতন্ত্রটিকে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আজও ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে আছে। এর পিছনে কতিপয় কারণ বিদ্যমান রয়েছে। স্যার আইভর জেনিংস সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ এর বহুবিধ কারণের কথা বলেছেন। এগুলো নিম্নরূপ:
১. রক্ষণশীলতা: রক্ষণশীলতা রাজতন্ত্র টিকে থাকার প্রথম কারণ। ইংরেজ জাতি অধিক মাত্রায় রক্ষণশীল। তারা কোন মৌলিক পরিবর্তনে আগ্রহী নয়। সনাতন ঐতিহ্যের প্রতি ইংরেজ জাতির আন্তরিক টান অনেক দিনের। দীর্ঘ দিন ধরে বিদ্যমান সকল প্রথা, রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানকে ইংরেজ জাতি মনে প্রাণে ভালোবাসে। রাজতন্ত্র হল ব্রিটেনের তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান। স্বভাবতই এর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জড়িত।
২. গণতন্ত্রীকরণ: গণতন্ত্রীকরণের কারণে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র আজও টিকে আছে। ব্রিটেনের রাজতন্ত্র তন্ত্র আজ নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত রয়েছে। এ রাজতন্ত্র ব্রিটেনের গণতন্ত্রের পথে কোন বাধা সৃষ্টি কি করেনি। গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজতন্ত্র প্রবাহমান। এ ব্যবস্থা সংসদীয় গণতন্ত্রের ত সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে। গৌরবময় বিপ্লবের (১৬৮৮) পর থেকে রাজা পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েছে।
৩. সংসদীয় ব্যবস্থার সমর্থক : ব্রিটেনে সংসদীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজা বা রানীর গুরুত্ব কম নয়। তিনি মন্ত্রিসভাকে সর্বত্রই সহায়তা করেন। তত্ত্বগতভাবে সকল ক্ষমতা রাজার নামে পরিচালিত হয়। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। রাজা বা রানী এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় কোন সমস্যা সৃষ্টি করছে না। এ কারণে রাজতন্ত্র টিকে আছে।
৪. রাজপদের ব্যবহারিক মূল্য : রাজপদের ব্যবহারিক মূল্যের কারণে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র বিদ্যমান। ব্রিটেনে মন্ত্রিসভার পরামর্শদাতা হিসেবে রাজশক্তির ব্যবহারিক মূল্য অনেক। তিনি নীতি নির্ধারণে মন্ত্রিসভাকে পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে তার গুরুত্ব অপরিসীম। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন আবার চলে যান। কিন্তু রাজা বা রানী সারাজীবন পদে আসীন থাকেন। কিন্তু মন্ত্রিসভার উত্থান-পতন হয়।
৫. ধারাবাহিকতা: ব্রিটেনে আজও প্রশাসনিক ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। রাজা বা রানী ঐ ব্যবস্থায় এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। ব্রিটেনের মন্ত্রিসভার পতন ও গঠনের সময় রাজার ভূমিকা অপরিসীম। এ সময় রাজা বা রানী প্রশাসনের হাল ধরেন। এ সময় তিনি ধারাবাহিক ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। অন্যথায় ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
৬. কম ব্যয়বহুল: ব্রিটেনের রাজতন্ত্র জাক জমকপূর্ণ, কিন্তু ব্যয়বহুল নয়। বাৎসরিক বাজেটের সামান্য অংশ এর পিছনে ব্যয় হয়। এ ব্যয় রাজস্বের শতকরা একভাগ মাত্র। উপযোগিতার তুলনায় এ ব্যয় অনেক কম। রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচনে নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে হলে ব্যয়ের পরিমাণ বেশী হত।
৭. মনস্তাত্তিক কারণ : মনস্তাত্তিক কারণে ব্রিটেনে আজও রাজতন্ত্র টিকে আছে। এটি রাজতন্ত্র টিকে থাকার সব চেয়ে বড় কারণ। মনস্তাত্তিক দিক থেকে ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্রিটেনের রাজা বা রানী জনগণের কাছে পিতা-মাতার ন্যায় প্রতিভাত হন। তিনি সর্বদা বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে আন্তরিকভাবে আলাপ আলোচনা করেন। প্রয়োজন মত বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
৮. ঐক্যের প্রতীক: ব্রিটেনের রাজা বা রানী ঐক্যের প্রতীকরূপে খ্যাত। তাকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ঐক্যের ধারক ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল। রাজা বা রানী সমগ্রদেশ ও দেশবাসীর অনুকূলে কথা বলেন। এ ভাবে তিনি ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করেন।
৯. সংযোগ সৃষ্টি: ব্রিটেনের রাজতন্ত্র কমনওয়েলথের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে থাকে। রাজা বা রানী হলেন কমনওয়েলথের প্রধান। ডোমিনিয়ন স্টেটগুলোর মধ্যে তিনি যোগসূত্র স্বরূপ। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো পূর্বে গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। রাজশক্তির মাধ্যমে এই দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি হয়।
১০. আনুষ্ঠানিকতা: আনুষ্ঠানিকতা ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য। ব্রিটেনের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রাজা বা রানী আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করেন। এখানে যাবতীয় কাজকর্ম রাজা বা রানীর নামে সম্পাদিত। বিচারকার্যও তাঁর নামে সম্পাদিত হয়। তার নামে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। জনগণ ব্যক্তি হিসেবে রাজায় প্রতি অনুরক্ত। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করেন।
১১. নিরপেক্ষতা: নিরপেক্ষতা ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের পিছনে ইন্ধন যোগায়। রাজা বা রানী ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় নিরপেক্ষ ব্যক্তি। তিনি নিরপেক্ষভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। রাজা বা রানী দলাদলির উর্ধ্বে থাকেন। তাঁর এ নিরপেক্ষতা রাজতন্ত্রকে বহাল রেখেছে।
১২. ব্যক্তিগত প্রভাব: ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার অন্যতম কারণ হল রাজা বা রানীর ব্যক্তিগত প্রভাব। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। এর মধ্যে ব্রিটেনের রাজশক্তির অস্তিত্বের কারণ নিহিত। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল মহারানী ভিক্টোরিয়া। তিনি জনগণের কাছে ছিলেন জননী সাদৃশ্য। রাজা জর্জ জনগণের জনকের মর্যাদা পেয়ে ছিলেন। সুতরাং রাজপদের ব্যক্তিত্বের প্রভাব রাজতন্ত্র টিকে থাকার অন্যতম কারণ।
১৩. জাঁকজমক ও বৈচিত্র্যের উৎস : ব্রিটেনের রাজা বা রানী জাঁকজমক ও বৈচিত্র্যের উৎস। এক ঘেয়েমী মানবজীবনে জাঁকজমক ও বৈচিত্র্যের বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। ব্রিটেনে সাধারণ মানুষকে রাজা বা রানী জাঁকজমকের সাথে জাগিয়ে তোলেন। সরকারী কার্যধারার মধ্যে তিনি বৈচিত্র সৃষ্টি করেন। আড়ম্বর ও সমারোহ প্রভৃতি সরকারী কাজের জন্য অপরিহার্য। এরূপ জাঁকজমক ও বৈচিত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উদ্যম সৃষ্টি করে।
১৪. চিরন্তন প্রতিনিধি : রাজা বা রানী ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় চিরন্তন প্রতিনিধি। তাঁর এ অসাধারণ অবদান রাজনীতিবিদদের পক্ষে সম্ভব নয়। নিরপেক্ষতার কারণে তাঁর নামে সরকারী কার্যাদি পরিচালিত হয়। এ কারণে জনগণের চোখে সরকারের মর্যাদা সমুন্নত থাকে। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় মহিমা ও গৌরব সমুন্নত রাখেন।
উপসংহার: রাজতন্ত্র ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ প্রতিষ্ঠানটি অনেক প্রাচীন। সুদীর্ঘকালের বিবর্তনের ধারায় ব্রিটেনের রাজতন্ত্র নিরবিচ্ছিন্নভাবে আজও টিকে আছে। রাজতন্ত্রের শুধু আকারগত দিকের পরিবর্তন ঘটেছে। অ্যাংলোসেক্সন যুগ থেকেই রাজসিংহাসন সৃষ্টি হয়। এ সময় থেকে রাজতন্ত্রের উদ্ভব। যদিও ব্রিটেনে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান- তবুও রাজতন্ত্র টিকে আছে।