ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো
প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার মধ্যমনি। গ্রেট ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। কারো কারো মতে ১৮৩২ সালের প্রথাগত (সংস্কার) আইনে প্রধানমন্ত্রীর পদটি সৃষ্টি করা হয়। সর্বপ্রথম রবার্ট ওয়ালপোল (Rovert Walpole) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। তিনি সর্ব প্রথম রাজার প্রধান পরামর্শ দাতা হিসেবে কাজ করেন। সাথে সাথে তিনি কসসসভার নেতা ও ক্যাবিনেটের নেতা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা মূলতঃ মন্ত্রিসভার উপর ন্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃত সরকার প্রধান। এ প্রসঙ্গে আইভর জেনিংস বলেন, 'All roads in the Constitution lead to the Prime minister,' ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় সরকারের গঠন, অস্তিত্ব ও অবসান প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তাঁকে কেন্দ্র করেই ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যবলী
ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। প্রধানমন্ত্রী হলেন এ শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তি। কিন্তু তার পরও এ পদটি আইনের দ্বারা সৃষ্টি হয় নি। মূলতঃ শাসনতান্ত্রিক রীতি নীতির ভিত্তিতে এ পদটি গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যবলীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে । যথাঃ
প্রধান পরামর্শদাতা: প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থার প্রধান পরামর্শদাতা। প্রধানমন্ত্রীকে রাজা বা রানী আনুষ্ঠানিক ভাবে নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানীর প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি রাজা বা রানীকে সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত করেন। রাজা বা রানীর বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেটের কাছে পৌঁছে দেন। কমন্সসভা ভেঙ্গে দেয়া, লর্ড সভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত ইত্যাদি রাজার পরামর্শক্রমে তিনি করে থাকেন ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা : প্রধানমন্ত্রী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। এ সুবাধে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলেরও নেতা হিসেবে তিনি পার্লামেন্টের ভেতরে ও বাইরে শৃংখলা ও মর্যাদা বজায় রাখেন । তিনি দলীয় শৃংখলা রক্ষা করেন। দলীয় সংহতি রক্ষা করা তাঁর একটি মহান দায়িত্ব । তাঁর এ নেতৃত্বের উপর ক্ষমতাসীন দলের ভবিষ্যত নির্ভরশীল।
কমন্স সভার নেতা: প্রধানমন্ত্রী কমন্সসভার নেতা। এ সভার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি কমন্স সভার অধিবেশন আহবান, সময় নির্ধারণ ও কর্মসূচী প্রনয়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বিরোধী দলের সময় বন্টন ও সভার কাজকর্ম পরিচালনা করেন। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের সাথে সেতু বন্ধন রচনা করেন। কমন্স সভার নেতা হিসেবে সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তগুলোকে জাতির সামনে তুলে ধরেন। এ নেতৃত্বদানে তাকে সরকারের মুখপাত্ররূপে আখ্যায়িত করা হয়। কমন্স সভার দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার দায়িত্বও তার উপর ন্যস্ত।
মন্ত্রিসভার নেতা: প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার নেতাও বটে। এ প্রধান মন্ত্রীকে রাজা বা রানী নিযুক্ত করেন। তিনি আবার মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদেরকে নিযুক্ত করেন। তবে পার্লামেন্টের সদস্য নন এমন ব্যক্তিকেও মন্ত্রী করা যায়। তাকে দু'মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের সদস্য হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অধঃস্তন কর্মচারীদের নিযুক্ত করেন। দলের ভবিষ্যত নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য এ ব্যবস্থা নেন।
ক্যাবিনেটের নেতা: তিনি ক্যাবিনেটের মার্যদা সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি ক্যাবিনেটের নেতা। বাস্তবে তিনি ক্যাবিনেটের মধ্যমণি, নেতা। তাঁকে কেন্দ্র করে ক্যাবিনেটের উত্থান-পতন। ক্যাবিনেট গঠনের ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ ক্ষমতা। প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেটের আয়তন ও সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করেন। কিন্তু রাজা বা রানী আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁকে নিযুক্ত করেন। তিনি ক্যাবিনেটের সদস্যদের মধ্যে দপ্তর বন্টন করেন। তিনি তাদের ক্ষমতাচ্যূত করার ব্যাপারে রাজা বা রানীকে পরামর্শ দেন। তাঁর নেতৃত্বের উপর ঐক্য ও সংহতি নির্ভর করে।
আন্তর্জাতিক নেতা: ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদটি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। তিনি আন্তর্জাতিক নেতাও বটে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বক্তব্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারী বক্তব্যরূপে স্বীকৃত। অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা অপরিসীম। প্রধানমন্ত্রী দেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। কমনওয়েলথের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দেশের পক্ষে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। জরুরি অবস্থায় পররাষ্ট্র বিষয়ে তিনি একক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
শাসন বিভাগীয় নেতা: ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী শাসন বিভাগের নেতা। শাসন বিভাগের যাবতীয় কাজ তাঁর নামে সম্পাদিত হয়। শাসক প্রধান হিসেবে সমগ্র দপ্তরের সুষ্ঠু কার্যকারিতা তিনি নিশ্চিত করেন। সরকারী নীতি কি ভাবে কার্যকরী হচ্ছে তিনি তা পর্যবেক্ষণ করেন। শাসন বিভাগীয় ঐক্য সৃষ্টি করা তার একটি গুরু দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে তিনি শাসন বিভাগীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করেন। কোন সমস্যা দেখা দিলে তিনি রাজা বা রানীর সাথে পরামর্শ করেন। সুতরাং তাঁর শাসন বিভাগীয় দায়িত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়োগ সংক্রান্ত কাজ: প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ কর্তাও বটে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপক নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা রয়েছে। উচ্চপদস্থ কর্মচারী, বিচারক ও যাজককের রাজা বা রানী নিয়োগ করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজা বা রানী এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করেন। বিশেষ করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের রাজা বা রানীর পরামর্শক্রমে তিনিই নিয়োগ করেন। কাজেই তার নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা অপরিসীম।
প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা: ব্রিটেনের শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী একজন মর্যাদাবান ব্যক্তি। তিনি গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিও বটে। আন্তর্জাতিক বিচারে তিনি একজন অন্যতম শক্তিশালী শাসক তত্ত্বগতভাবে না হলেও বাস্তব প্রেক্ষাপটে তিনিই রাষ্ট্রপ্রধান। এত ব্যাপক ক্ষমতা পৃথিবীতে অন্য কোন দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত নেই। এ ক্ষেত্রে তার পদ মর্যাদা মার্কিন রাষ্ট্রপতির সাথে তুলনীয়। এ ক্ষেত্রে গ্রীভস (Greaves) মনে করেন, “The government is the master of the country and the prime minister is the master of the government, তাই ব্রিটেনে শাসন ব্যবস্থাকে সংসদীয় সরকার” না বলে “প্রধানমন্ত্রীর সরকার” বলাই সঙ্গত।
বলা যায় যে, ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে যাবতীয় কার্যাদি পরিচালিত হয়। তাঁর নেতৃত্বের উপর ব্রিটেন সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। তিনি হলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি জনগণেরও নেতা। তাই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, যোগ্যতা ও পদমর্যাদা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে তুলনীয়।