ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দলকে অস্বীকার করা যাবে না। ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো একদিনে গড়ে ওঠেনি। এসব রাজনৈতিক দলের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। মহারানি প্রথম এলিজাবেথের শাসনামলে দলীয় রাজনীতির সূত্রপাত হয়।
ব্রিটিশ দল ব্যবস্থা বিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। একদিনে ব্রিটিশ দল ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। মহারানি প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালে ব্রিটেনে দলীয় রাজনীতির সূত্রপাতকালীন সময়ে শাসনব্যবস্থায় মান ক্ষুণ্ণ হয়ে পিউরিটনিগণ পার্লামেন্টের সদস্যপদ লাভ করে শাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান।
তাই ব্রিটেনে দল ব্যবস্থার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, দলীয় ব্যবস্থার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে অনেক দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তারা রাজনৈতিক দলের বিকাশ, সরকার ব্যবস্থা গঠন, সরকার ব্যবস্থা পরিচালনা, জনগণের প্রতিনিধিত্ব, গণতন্ত্রকে সংহত করা ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দেন।
যেমন- ব্রিটিশ দলীয় ব্যবস্থার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে Dr. J. C. Johari বলেন, "British party system like coustitution itself has evolved character. As such the history of its origin and growth dates back to the early phase of the modern period when two corditious contributed to the evolution of the party system, namely the movement body in all its essentials become a legislative body in all its that there should be political issues of a broad and deep character on which the people may combine themeselves in group.""
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ব্রিটেনে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ পুরোদমে শুরু হয়। স্টুয়ার্ট রাজাদের আমলেই দল ব্যবস্থা প্রসিদ্ধি লাভ করে। পিউরিটনিগণ পার্লামেন্টের সমর্থক ছিলেন। ক্যাভিলিয়ররা রাজার সমর্থন ছিল। তাদের মধ্যে বিবাদে রাজার সমর্থকগণ পরান্ত হন। ক্রমওয়েল লর্ড প্রোটেস্টর রূপে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।
ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর রাজা ২য় চার্লস আবার শাসনভার গ্রহণ করেন। ব্রিটেনে দলীয় ব্যবস্থা প্রথমে টোরি এবং হুইগ দলকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে টোরি ও হুইগ দল Conservative ও Liberal পরিণত হয়। ১৯৮২ সালে দলগুলোর নাম পরিবর্তন হয়ে রক্ষণশীল ও উদারপন্থি নামে পরিচিত হয়। ১৮৩২ সালে ব্রিটেনে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয়। এ সময় প্রত্যেক দলের আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে ওঠে।
১৮৬৭ সালে ব্রিটেনে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার আইন পাস হয়। ১৮৬৮ সালের নির্বাচনে লিবারেল পার্টি কমন সভায় ৩৮৪টিও রক্ষণশীল দল ২৭৪টি আসন পায়। ১৯০০ সালে শ্রমিক দল গঠিত হলে লিবারেল দলের অনেক সদস্য শ্রমিক দলে চলে আসে। ইতোমধ্যে লিবারেল পার্টি ভেঙে যায় এবং অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে Labour Party ও Conservative Party শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত।
ব্রিটেনে দল ব্যবস্থা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এটা হলো শতাব্দীর বিবর্তনের ফল। এ দল ব্যবস্থা ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বহু প্রতিষ্ঠানকে সুসংবদ্ধ রূপ দিয়েছে যা বিশ্বের বহু রাষ্ট্রের জন্য অনুকরণীয়।
ব্রিটেনের দল ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য/যুক্তরাজ্যের দলীয় ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
১. দ্বিদলীয় ব্যবস্থা: দ্বিদলীয় ব্যবস্থা ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রধান দুটি দল ছিল, হুইগ দল ও টোরি দল। পরবর্তীতে হুইগ দল Liberal নামে ও টোরি দল Conservative নামে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে Liberal দলে ভাঙন দেখা দেয় এবং Labour Party গঠিত হয়। তৃতীয় দল হিসেবে Liberal Party দুর্বল অবস্থানে আছে। বর্তমানে ব্রিটেনের বিদলীয় ব্যবস্থা ভাঙার পথে। যে কারণে Coalition সরকারও গঠিত হয়। তবে ব্রিটেনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু দলও বিদ্যমান রয়েছে।
২. মতাদর্শগত পার্থক্য: বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রধান দলসমূহের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য যেমন রয়েছে তেমনি ব্যাপক মতৈক্যও বিদ্যমান। শ্রমিক দল যেমন শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় মনোনিবেশ করে থাকেন অন্যদিকে রক্ষণশীল দল সমাজের উঁচুতরের লোকদের স্বার্থরক্ষার কাজ করেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের দাবি তারা উপস্থিত করেনি এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতার ধারণার উপর ভিত্তি করেই তারা সকল কর্মসূচি রচনা ও প্রয়োগ করে।
৩. সাংবিধানিক পন্থা অবলম্বন: ব্রিটিশ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হিংসাত্মক ও অগণতান্ত্রিক পন্থা সুকৌশলে এড়িয়ে যায়। তারা গণতন্ত্র ও সংবিধানের ধারক ও বাহক।
৪. কর্মসূচিভিত্তিক দল: ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলগুলো কর্মসূচিভিত্তিক কাজ করে। প্রত্যেক দলেরই স্বতন্ত্র আদর্শ রয়েছে। দলগুলো আদর্শের বাইরে কাজ করে না।
৫. সরকার গঠন : ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত। যে কারণে নির্বাচনে জয়ী হয়ে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন তাদের উদ্দেশ্য।
৬. ক্ষমতা অর্জন: ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে সে দল ক্ষমতায় যায়।
৭. দলীয় শৃঙ্খলা: ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলীয় শৃঙ্খলা বিদ্যমান। দলীয় শৃঙ্খলা নষ্ট করা ও আদেশ অমান্য করার নজির বিরল। শৃঙ্খলা রক্ষায় শৈথিল্য ক্যাবিনেটের স্থায়িত্ব বিপন্ন করতে পারতো।
৮. মধ্যপন্থা অবলম্বন: ব্রিটেনের প্রতিটি দলই তাদের কর্মসূচিতে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে থাকে। তাদের দলীয় কর্মসূচি সকল শ্রেণি ও পেশার জন্য। সকল শ্রেণিই তাদের দলীয় কর্মসূচিতে সন্তুষ্ট থাকে।
৯. জনমত সৃষ্টি : গ্রেট ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি তৈরি করে জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হতে চায়। তারা জনমতকে মূল্যায়ন করে থাকে।
১০. গণতন্ত্রের চর্চা: ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। শুধু ক্ষমতায় যাবার পর জনকল্যাণ সাধন করা যাবে এ ব্যাপারে তারা গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দেয় ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপর পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল থাকে।
১১. নমনীয়তা: নমনীয়তা ব্রিটিশ রাজনৈতিক দল ব্যবস্থায় একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। জনগণের বৃহৎ মঙ্গল সাধনে ও জাতির কল্যাণে তাদের দল ব্যবস্থায় নমনীয়তা লক্ষণীয়।
১২. রাজনৈতিক দলের ভূমিকা: ব্রিটেনের দল ব্যবস্থাই গণতন্ত্রের রূপরেখায় পরিবর্তন সাধন করেছে। রাজা বা রানির ক্ষমতা, পার্লামেন্টের ক্ষমতা, ক্যাবিনেটের কর্তৃত্ব, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সব কিছুতেই ব্রিটিশ রাজনৈতিক দলের ভূমিকা সুস্পষ্ট।
১৩. ছায়া সরকার গঠন: ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে পরাজিত দল ভবিষ্যৎ সরকার পরিচালনার জন্য একটি ছায়া সরকার গঠন করে রাখে। দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে গঠিত হয়। যদি সরকারি দল পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে হেরে যায় তাহলে ছায়া সরকার প্রস্তুত থাকে।
১৪. গণভিত্তিক দলীয় ব্যবস্থা : ব্রিটেনের দলীয় ব্যবস্থা গণভিত্তিক । জনগণের চাহিদা অনুযায়ী দলগুলো তাদের আদর্শ ও কর্মসূচি তৈরি করে। নির্বাচনে যে আদর্শ ও কর্মসূচি জনগণের পছন্দ হবে সে দলই ভোটে জয়ী হবে।