মরিস দ্যুভারজারের রাজনৈতিক দল তত্ত্ব
মরিস দ্যুভারজারের রাজনৈতিক পার্টিতত্ত্ব
মরিস দ্যুভারজারের পার্টিতত্ত্ব
ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মরিস দ্যুভারজার তার "Political parties" নামক গ্রন্থে রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, "A party is a community with a particular structure. অর্থাৎ রাজনৈতিক দল হলো কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের একটি নির্দিষ্ট অবকাঠামো। তিনি রাজনৈতিক দলের কাঠামোকে প্রাথমিকভাবে ২ ভাগে বিভক্ত করেন। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
প্রত্যক্ষ কাঠামো : প্রত্যক্ষ কাঠামো এমন একটি কাঠামো যেখানে রাজনৈতিক দলের সদস্যরা অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীর সাহায্য ছাড়াই দলীয় সংগঠন গড়ে তোলে। এই ধরনের দলীয় সংগঠনে সদস্যগণ দলীয় সদস্যপদ পূরণের মাধ্যমে সরাসরি দলের সদস্য হয়। এমনকি সদস্যগণ মাসিক চাঁদা প্রদান করে এবং সাধারণত দলের স্থানীয় শাখায় সভায় উপস্থিত থাকেন। ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক দল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
পরোক্ষ কাঠামো: পরোক্ষ কাঠামোর ক্ষেত্রে ঐক্যের বহু সামাজিক গোষ্ঠী, পেশাদারি গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি সরাসরি দলের সদস্য হয় না, দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনো সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে কোনো ব্যক্তি দলের সদস্য হয়। পরোক্ষ কাঠামোর রাজনৈতিক দল বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন গোষ্ঠী সমবায় সমিতি, শ্রমিক সংঘ, কৃষক সংঘ ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত হয়। ১৯০০ সালে গঠিত ব্রিটিশ লেবার পার্টি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পরোক্ষ দলকে আবার ৩টি ভাগে বিভক্ত করা যায়।
i. শ্রমিকদের ইউনিয়ন, সমবায় সংগঠন এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সংগঠনের সমন্বয়ে একই সামাজিক শ্রেণিভুক্ত দল গঠিত হয়। বেলজিয়ান ওয়ার্কা পার্টি এর উদাহরণ।
ii. বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণিভুক্ত দল গঠিত হতে পারে। যেমন- অস্ট্রিয়ার পিপলস পার্টি।
iii. কৃষিভিত্তিক দল হতে পারে যেখানে কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠন। সমবায় সংগঠন রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করে।
রাজনৈতিক দলের উপাদান : সকল রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সাংগঠনিক কাঠামো আছে যা তাকে অন্য দল থেকে পৃথক করে। দ্যুভারজারের মতে দলীয় কাঠামোর চারটি মৌলিক উপাদান রয়েছে। এই মৌলিক উপাদানসমূহের মধ্যে প্রতিনিধি মনোনয়ন, নির্বাচনের ব্যাপারে নীতিনির্ধারণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রাজনৈতিক দলের কাঠামো
মরিস দ্যুভারজার চার ধরনের দলীয় কাঠামোর কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো: ককাস, শাখা গুপ্ত দল ও আধা-সামরিক বাহিনী। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
ককাস : ককাস একটি সনাতন দলীয় কাঠামো। এটাকে দলের একটি কমিটি বা চক্র বলা হয়। কমিটি বা চক্রের পরিধি অত্যন্ত সীমিত। সামান্য কিছু সদস্যের সমন্বয়ে এই কমিটি বা চক্র গঠিত হয়। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভ্রান্ত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ককাস গড়ে উঠে। সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কোনো ধরনের প্রচারনার ককাস অংশগ্রহণ করে না। সুতরাং ককাস হলো একটি সীমাবদ্ধ গোষ্ঠী। ককাস সদস্যপদ প্রদানের ক্ষেত্রেও সংখ্যার পরিবর্তে গুণগতমানের উপর বেশি জোর দিয়ে থাকে। ককাসের কার্যাবলি মূলত নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। নির্বাচনি প্রচারনার জন্য এর উদ্ভব ঘটে এবং নির্বাচনের সমাপ্তিতে এর প্রয়োজন শেষ হয়। এজন্য স্থায়িত্বের ব্যাপারে ককাস আধা-স্থায়ী প্রকৃতির।
শাখা : মরিস দ্যুভারজারের মতে সমাজতন্ত্রীগণ শাখা পার্টির উদ্ভব ঘটিয়েছেন। পশ্চিম ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দলগুলি রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে শাখা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। শাখা পার্টির মৌলিকত্ব তার সাংগঠনিক চরিত্রের মধ্যেই বিদ্যমান। শাখা পার্টির পরিধি অত্যন্ত ব্যপক। এমনকি পার্টি নিজেই নিজের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং নিজের শক্তি বৃদ্ধির প্রয়াসে নিয়োজিত থাকে। শাখা পার্টিতে সুনির্দিষ্ট ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ দেখা যায়। এতে দায়িত্ব বণ্টন ব্যবস্থাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট। শাখা পার্টি এককেন্দ্রিক প্রবণতার দ্বারা পরিচালিত হয়। সমগ্র সংগঠনের অন্যতম অংশ হিসেবে কার্য পরিচালনা করে।
গুপ্তদল : শাখা দল ও গুপ্ত দলের ভিত্তি এবং সদস্য সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। গুপ্তদল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন বিশিষ্ট এর সদস্য সংখ্যা সীমিত। ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট এবং সীমিত সদস্য সংখ্যার কারণে সদস্য সংখ্যার উপর দলের নিরঙ্কুশ | প্রাধান্য বজায় থাকে। এ ধরনের দলীয় কাঠামো কোনো নির্দিষ্ট স্থান কার্যরত দলীয় সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করে থাকে। গুপ্ত দলের স্থায়ী চরিত্র থাকে। দলীয় সদস্যগণ নিজেদের | কর্মস্থলে নিয়মিতভাবে মিলিত হন। সভা সমিতি ছাড়াও নিজেদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।
আধা সামরিক বাহিনী : পরিশেষে দ্যুভারজারের মিলিশিয়া আধা সামরিক বাহিনীতে দলীয় সংগঠন হিসেবে বা সামরিকবাহিনীর মতো ক্রমস্তরে বিন্যস্ত থাকে। তার সদস্যদের সামরিকবাহিনীর সদস্যদের পদ্ধতিতে নিযুক্ত করা হয়। সৈন্যদের মতো একই শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণে সদস্যদের শিক্ষিত করা হয়। তবে এ ধরনের সদস্যদের বেসামরিক চরিত্রও বজায় থাকে। আধা-সামরিক বাহিনীতে দুই ধরনের সদস্য থাকে। যথা- সক্রিয় ও সংরক্ষিত। দলের কাঠামোকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করা হয়। বিপ্লবী দলগুলো কমিউনিস্ট পার্টির সেল সংগঠনের মতো মিলিশিয়া ধরনের দলীয় সংগঠন অবলম্বন করে ।
সমালোচনা
মরিস দ্যুভারজারের দলীয় সংগঠন সম্পর্কে উপরিউক্ত শ্রেণিবিভাজন আধুনিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ কঠোর সমালোচনা করেছেন। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
ব্লনডেল এর মতে, ককাস পার্টি হলো পরোক্ষ শাসনের দল এবং গণভিত্তিক দল হলো প্রত্যক্ষ শাসনের দল। তিনি সদস্য সংখ্যার উপর জোর দেননি। তিনি নেতৃবৃন্দের সাথে সমর্থকদের সম্পর্কের প্রকৃতির উপর জোর দিয়েছেন।
অধ্যাপক অ্যালান বল রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে মরিস দ্যুভারজারের মতের সমালোচনা করেছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মরিস দ্যুভারজারে রাজনৈতিক পার্টি তত্ত্ব নিঃসন্দেহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দলের কাঠামোর যে শ্রেণিবিভাগ করেছেন তার মাধ্যমেই রাজনৈতিক দলকে শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করানো যায়। এছাড়া তিনি দলীয় সুনির্দিষ্ট ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগের এক সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তাই সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও বলা যায় যে, মরিস দ্যুভারজারের রাজনৈতিক দল তত্ত্ব অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ।