ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস সমূহ আলোচনা কর।
ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস -Sources of the British Constitution
গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান একটি অলিখিত সংবিধান। এটি ইতিহাসের ক্রমবর্ধমান বিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। ব্রিটেনের সংবিধান কোন নির্দিষ্ট উৎস থেকে উৎসারিত হয় নি। এর একাধিক উৎস রয়েছে। ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত হলেও এর কিছু কিছু লিখিত অংশও রয়েছে। বাস্তবে, ব্রিটেনের সংবিধান লিখিত এবং অলিখিত উভয় প্রকার উপাদানের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। বস্তুতঃ একে লিখিত আইন এবং আচার ও প্রথার এক অপূর্ব সমন্বয় বলে উল্লেখ করা যায়। নিম্নলিখিত ঐতিহাসিক উপাদানগুলো গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধানকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। যথা:
ঐতিহাসিক সনদ
ব্রিটিশ সংবিধানের উৎসগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক সনদের স্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ সংবিধান মূলতঃ একাধিক সনদ ও চুক্তির সমন্বয়ে গঠিত। এ সকল সনদ ও চুক্তি শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ নির্ধারণ করে থাকে। ফলে তা শাসনতন্ত্রের উৎস রূপে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ ১২১৫ সালের মহাসনদ (ম্যাগনাকার্টা ), ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস, ১৬৮৯ সালের অধিকারের বিল ইত্যাদি। এগুলো ব্রিটেনের সংবিধানের বিকাশ ধারায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শক হিসেবে বিদ্যমান। নাগরিক অধিকার এবং শাসক-শাসিতের সম্পর্ক এসব দলিলে বিবৃত হয়েছে।
বিধিবদ্ধ আইন
ব্রিটেনের পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনগুলো ব্রিটেনের সংবিধানের অন্যতম উৎস। এ সকল আইন ব্রিটেনের পার্লামেন্টে বিভিন্নভাবে প্রণীত হয়েছে। ১৭০১ সালের হেবিয়াস কর্পাস এ্যাক্ট সেটেলমেন্ট, ১৬৭৯, ১৮৩২, ১৮৬৭ এবং ১৮৮৪ সালের সংস্কার আইন সমূহ, ১৯২৮ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন প্রভৃতি সংবিধানের উৎস হিসেবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া ১৯১১ এবং ১৯৪৯ সালের পার্লামেন্ট অ্যাক্ট লর্ড সভার ক্ষমতা সীমিত করে সংবিধানের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত
ব্রিটেনে বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত বা বিচারকদের রায় ও ব্যাখ্যা ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস বলে বিবেচিত হয়েছে। বিচার কালে বিচারকগণ বিভিন্ন সনদ, প্রথাগত আইন এবং বিধিবদ্ধ আইনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে নতুন সাংবিধানিক আইনের সৃষ্টি করেছেন। ডাইসির মতে, “ইংল্যান্ডের সংবিধান বিচারকের দ্বারা তৈরি সংবিধান”। ফলে অনেকে ব্রিটেনের সংবিধানকে “বিচারক প্রণীত সংবিধান" (Judge made constitution) বলে থাকেন।
সাধারণ আইন
ব্রিটেনের সাধারণ আইনগুলো রাজার আদেশ অথবা পার্লামেন্টের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রথার ভিত্তিতেই বিকাশ লাভ করেছে, বিচারকার্য পরিচালনার সময় বিচারকেরা প্রথাগুলোকে স্বীকার করেন, ব্যক্তির মামলায় প্রয়োগ করেন এবং পরবর্তী মামলার নিষ্পত্তির জন্য এগুলো নজির হিসাবে গণ্য করেন। অধ্যাপক অগ্-এর মতে, “এসব রীতি-নীতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রচলিত থেকে অলংঘনীয়, সুচারু এবং স্থায়ী হয়ে উঠেছে।” এরূপ আইন বিভিন্ন নাগরিক স্বাধীনতারও নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে । যেমন জনসাধারণের পৌর-স্বাধীনতা, সভা সমিতির স্বাধীনতা, রাষ্ট্রের ভিতরে ও বাইরে ব্যক্তি মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
প্ৰথা সমূহ
গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছ প্রচলিত প্রথা বা প্রথাগত বিধান। প্রথাগত বিধানকে ব্রিটেনের সংবিধানের কেন্দ্র ও আত্মা বলা হয়। প্রথাগুলো আইন নয়, কিন্তু আইনের মত মান্য করা হয়। কিন্তু যারা শাসন পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন, যারা রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিচালনা করেন অথবা যারা সরকারের বিরোধিতা করেন তাঁরা সকলেই প্রথাগুলো মেনে চলেন। গ্রেট ব্রিটেনের রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। অগ-এর মতে, “প্রথাগুলো এমন কতকগুলো বুঝাপড়া ও অভ্যাস যা সরকারী কর্তৃপক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।” গ্রেট ব্রিটেনের পার্লামেন্টের কার্যপদ্ধতি, পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিপরিষদের সম্পর্ক, ক্যাবিনেটের কাজ ও রাজার ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়গুলো প্রথাগত বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
বিখ্যাত আইনবিদদের লেখনী
বিখ্যাত আইনবিদদের লেখা প্রস্তাবগুলো বিভিন্নভাবে গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধানকে প্রভাবিত করেছে। এ সমস্ত লেখকদের রচনায় সংবিধানের আইন সম্পর্কে মূল্যবান ভাষ্য দেখতে পাওয়া যায়। লেখকগণ তাঁদের লেখনীতে প্রথাগত বিধানগুলোকে বিধিবদ্ধ করেছেন। একটির সাথে অন্যটির সম্পর্ক স্থাপন করেছেন ও একটি কেন্দ্রীয় নীতির সাথে সামঞ্জস্যমূলকভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করছেন। কোন বিষয়ে ইংল্যান্ডের সাংবিধানিক বিধান বুঝার জন্য এসব ভাষ্য পাঠ করা যেতে পারে। ওয়ালটার বেজহট, এ. ভি. ডাইসী, হ্যারল্ড লাস্কি, ডব্লিউ. আর. অ্যানসন প্রমুখের গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
চূড়ান্ত কথা
ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, গ্রেট ব্রিটেনের সংবিধান কোন সচেতন প্রচেষ্টার ফল নয়। বরং তা দেশাচার, প্রচলিত বিধিবিধান, বিচারালয়ের সিদ্ধান্ত ও অতীতের ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। এই সংবিধান বিশেষ একটি উৎস হতে উৎসারিত হয় নি, বরং তা বহু উৎসের ফলস্বরূপ। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এ সংবিধান পরিবর্তিত অবস্থার মোকাবেলা করতে সমর্থ হয়েছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্রিটেনের সংবিধান বারবার পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।