আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা আলোচনা কর।

গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণ কর্তৃক পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। বর্তমান সময়ের বিশালায়তন রাষ্ট্রগুলোর বিপুল জনগোষ্ঠীর পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের মাধ্যে পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে। আধুনিক গণতন্ত্রকে তাই 'প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র' বলা হয়। প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হল রাজনৈতিক দল। এজন্যই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে দলীয় শাসনা বলা হয়। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিম্নরূপ :



আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা

১. সমস্যা নির্বাচন : আধুনিক রাষ্ট্রগুলো আয়তনে যেমন বিশাল, জনসংখ্যাও তেমনি বিপুল। এসব রাষ্ট্রের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও অসংখ্য এবং বিচিত্র প্রকৃতির। এরূপ অসংখ্যা ও জটিল সমস্যা নির্ণয় এবং এগুলোর মধ্যে কোন সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন তা নির্ণয় করা রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান কাজ।

২. নীতি নির্ধারণ ও কর্মসূচি প্রণয়ন : মানুষের অগণিত সমস্যা বিশৃঙ্খলভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এর মধ্য থেকে অধিক গুরুত্বসম্পন্ন সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে দলগুলো জনসমর্থন লাভের প্রচেষ্টায় চালায়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই বিশ্বাস করে যে, তাদের নীতি ও কর্মসূচিই সঠিক এবং তাদের নীতি ও কর্মসূচি অনুসারেই বিভিন্ন সমস্যাবলির সমাধান সম্ভব। সোয়েলের মতে, “জনমতকে সবার সামনে উপস্থাপিত করে গণরায় আদায়ের জন্য উপযুক্ত কর্মসূচি প্রণয়ন করা রাজনৈতিক দলের অন্যতম লক্ষ্য। 

৩. নিজ দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা : রাজনৈতিক দলগুলোর নিজ দলের মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা থাকা উচিত। দলের সর্বোচ্চ পদ থেকে সর্বনিম্ন পদের অধিকারীকে দলীয় কনভেনশন বা কাউন্সিলে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া উচিত। দলের মধ্যে স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ থাকা উচিত।

৪. জনমত গঠন : নির্ধারিত নীতি ও কর্মসূচির সপক্ষে জনমত গঠন করা রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান কাজ। রাজনৈতিক দল বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রচারের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে। 

৫. প্রার্থী মনোনয়ন: নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ দল হতে প্রার্থী মনোনয়ন দান করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বে নির্বাচনের সময় নির্বাচক বা ভোটারগণ যখন কোন প্রার্থীর পক্ষে ভোট প্রদান করে তখন তারা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে, কোন কর্মসূচি বা নীতির পক্ষে তারা ভোট প্রদান করছে।

৬. প্রচারণা : প্রার্থী মনোনয়নের পর রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ দলীয় কর্মসূচি ও নীতিসমূহ এবং তাদের প্রার্থীর সপক্ষে প্রচারকার্য চালায়। এর ফলে নির্বাচকমণ্ডলী দেশের জন্য কোন কর্মসূচি বা নীতি গ্রহণযোগ্য এবং কোন প্রার্থীকে ভোট দেওয়া উচিত তা সহজেই এবং সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারে।

৭. নির্বাচকদের স্বার্থ সংরক্ষণ: সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার নীতি স্বীকৃত হওয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকগণ প্রত্যেক দেশেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। ভোটদাতাদের তালিকায় কোন নির্বাচন বা ভোটারের নাম ভুলবশত বা ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়ল কিনা, ভোটের সময় নির্বাচকগণ কোন চাপ ছাড়াই ভোট দিতে পারছে কিনা, ভোট গণনার কোন অন্যায় বা কারচুপি হচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে রাজনৈতিক দল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। এর ফলে নির্বাচন বা ভোটারদের রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।

৮. সরকার গঠন : প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজ ও লক্ষ্য হল সরকারি ক্ষমতা দখল ও সরকার গঠন করা। নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সে দল সরকার গঠন করে এবং নির্বাচনপূর্ব প্রদত্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো পালনের চেষ্টা করে। সরকার গঠন করার মাধ্যমেই রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সুযোগ লাভ করে।

৯. বিরোধী ভূমিকা পালন : নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে এবং অন্যান্য দলগুলো বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী দলগুলো সরকারের ভুল-ত্রুটি এবং সরকারের গণবিরোধী কাজগুলোর ক্ষতিকর দিকসমূহ জনগণের সামনে তুলে ধরে। এর ফলে বিরোধী দলগুলো যেমন জনগণের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়, তেমনি সরকারি দলও জনসমর্থন লাভের জন্য জনগণের জন্য কল্যাণকর কাজে সচেষ্ট হয়।

১০. রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার প্রসার: উদারনৈতিক গণতন্ত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজ নিজ দলীয় নীতি ও কর্মসূচির পক্ষে প্রচারণা চালায়। জনসমর্থন পাওয়ার জন্যই এরূপ প্রচারণা চালানো হয়। এর ফলে জনগণের উদাসীনতা ও অজ্ঞতা দূর হয়। জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার প্রসার ঘটে।

১১. স্বৈরাচারিতা প্রতিরোধ : রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ কোন দল বা গোষ্ঠীর স্বৈরাচারী কার্যকলাপ জনসমক্ষে তুলে ধরে। এর ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে গণবিরোধী ও সেচ্ছাচারী কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি কোন বিরোধী দলের পক্ষেও একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী শাসন পদ্ধতির পক্ষে প্রচারণা চালানো সম্ভব হয় না ।

১২. জনমতের বাস্তবরূপ দান: নির্বাচনে জয়লাভ করে রাজনৈতিক দলগুলো জনমতের সপক্ষে আইন প্রণয়ন করে ও শাসনকার্য পরিচালনা করে। এর ফলে জনমত বাস্তবরূপ পরিগ্রহ করে।

১৩. শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ক্ষমতা পরিবর্তন : জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হলে পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত না করে অন্য কোন দলকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। অর্থাৎ পরিবর্তনের জন্য কোন বিপ্লব বা বিদ্রোহের প্রয়োজন হয় না।

১৪. সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সংযোগ সাধন: সংসদীয় গণতন্ত্রে শাসন বিভাগ অর্থাৎ মন্ত্রিপরিষদকে আইনসভার নিকট দায়ী থাকতে হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় বলে মন্ত্রিপরিষদকে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারেও রাজনৈতিক দল শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার কখন গড়ে তোলে।

১৫. জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টি: উদারনৈতিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে দলীয় নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে। ফলে ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত সংকীর্ণ স্বার্থ বা মনোবৃত্তি গড়ে উঠতে পারে না।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url