বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বাংলাদেশে জনগণের মত প্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা স্বীকৃত। ফলে একাধিক রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পাওয়া যায়।
১. বহুদলীয় ব্যবস্থা : বাংলাদেশে বহুদল ব্যবস্থা বিদ্যমান। যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, আদর্শগত বিভেদ, নেতৃত্ব কর্তৃত্ব অর্জনের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা, সহনশীলতার অভাব, সামরিক হস্তক্ষেপ, বিদেশী শক্তির প্রভাব, বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করার মানসিকতা, গণচেতনার অভাব, রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগত দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে বাংলাদেশে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলো বহুধাবিভক্ত হয়ে অন্য রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি করেছে।
২. সুসংহত রাজনৈতিক দলের অভাব: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশই সঠিক নয়। অল্পসংখ্যক দলেরই সারাদেশব্যাপী একা সংগঠন রয়েছে। নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল জন্মগ্রহ করলেও পরবর্তীতে তা শহর ও রাজধানীর মধ্যেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত রাখতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে আওয়ামী লীগ, বি.এন.পি. জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু) প্রভৃতি দলগুলোর কর্মকান্ড সমগ্র দেশে বিস্তৃত রয়েছে।
৩. দলব্যবস্থার ভিত্তি: বাংলাদেশে বেশ কিছু দল রয়েছে যেগুলো অর্থনৈতিক কর্মসূচির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে যেমন- আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি প্রভৃতি। ব্রিটিশ ভারতে ১৯০৬ সালে ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের জন্য হয়। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক যে দলগুলো গড়ে উঠেছে সেগুলো হল- জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন বা ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ প্রভৃতি।
৪. আদর্শগত পার্থক্য: বাংলাদেশে বিদ্যমান দলগুলো মূলত বামপন্থি, ডানপন্থি ও মধ্যপন্থি বা সোসাল ডেমোক্রাট এই তিন ভাগে বিভক্ত। বামপদ্ধি দলগুলো আদর্শগতভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই দলগুলো ব্যক্তিমালিকানা বিরোধী এবং মানুষ মানুষে শোষণ ও নির্যাতনে বিশ্বাসী নয়। এরূপ বামপন্থি ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, জাসদ (রব), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু), বাসদ প্রভৃতি। অপরদিকে ডানপন্থি দলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাসী। ডানপন্থি দলগুলো হচ্ছে বি.এন.পি, জাতীয় পার্টি, মুসলিম লীগ, ডেমোক্রেটিক লীগ, জাতীয় লীগ প্রভৃতি। জামায়াতে ইসলামী ডানপন্থি হলেও অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদে বিশ্বাস করে না। আওয়ামী লীগ 'না ডানপন্থি, না বামপন্থি' রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল ও উদার গণতান্ত্রিক দল।
৫. দলীয় কোন্দন : বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যেই বিদ্যমান কোন্দলের মূল কারণ যতটা না আদর্শকেন্দ্রিক তার থেকে বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। দলীয় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অর্জনের জন্যই সাধারণত এসব দলীয় কোন্দল লক্ষ করা যায়। এর ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ দলের মধ্যেই ভাঙন এবং নতুন নতুন দল গড়ে ওঠার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, বি.এন.পি, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে এরূপ ভাঙনের প্রক্রিয়া অতীতে বহুবার লক্ষ করা গেছে।
৬. দলত্যাগের প্রবণতা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল দলীয় নেতাদের একাংশের ঘন ঘন দল পরিবর্তন। বাংলাদেশে খুব সহজেই যে কোন ব্যক্তি এক দল ত্যাগ করে অন্য দলে যোগদান করতে পারে। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই এরূপ প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষমতা লাভের স্বার্থে বা ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ পাবার জন্য দীর্ঘদিন একটি রাজনৈতিক দলে অবস্থান করার পরেও নতুন দলে যোগ দিতে এবং ক্ষমতাসীন ব্যক্তিকে সমর্থন জানাতে তাদের বিবেকে বাধে না।
৭. দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার অভাব : বাংলাদেশে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা নেই বললেই চলে। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে দলীয় কাউন্সিল হয় না। দলীয় সভাপতির মনোনীত ব্যক্তিগণই বিভিন্ন পদে নিযুক্তি হন।
৮. বিরোধী দলের ভূমিকা : বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলো অধিকাংশ সময়ে নিছক বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করে থাকে। অনেক সময় ক্ষমতাসীন দলের গৃহীত কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত ভালো হলেও বিরোধী দলগুলো তার সমালোচনা করে থাকে। বাংলাদেশের অনেক বিরোধী দলই অতীতে সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছে এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী কাজে সমর্থন প্রদান করেছে।
৯. অবসরভোগী সৈনিক ও আমলাদের দল গঠনের প্রবণতা : বাংলাদেশের দলব্যবস্থায় অবসরভোগী সৈনিক ও আমলাদের মধ্যে দল গঠনের কিংবা কোন রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণের প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন ডান ও বামপন্থি নেতাদের নিয়ে 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল' নামে একটি দল গঠন করেন এবং তার সামরিক শাসনকে বৈধ করে নেওয়ার প্রয়াস চালান। একই নিয়মে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদও বিভিন্ন দলের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতাদেরকে নিয়ে 'জাতীয় পার্টি' নামে একটি দল গঠন করেছেন। তবে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও বেসামরিক আমলাগণ সর্বদাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলেই সাধারণত যোগদান করে থাকেন।
১০. রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রাধান্য : বাংলাদেশের দলব্যবস্থার একটি লক্ষণীয় বিষয় হল এই যে, এখানে ক্ষমতায় থাকলে একটি শক্তিশালী দল গঠন করা অত্যন্ত সহজ। ক্ষমতাচ্যুত হলে দলের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয় এবং সুবিধাবাদী নেতা ও কর্মিগণ আবারও দল বদল করে ক্ষমতাসীন দলে যোগদান করেন।
১১. ছাত্র ফ্রন্ট: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থায় ছাত্রসমাজের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেই ছাত্র ফ্রন্ট রয়েছে। এই ফ্রন্টগুলো রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও কর্মসূচির প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে অন্ধভাবে মূল রাজনৈতিক দলের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হতে দেখা যায়।
১২. কৃষক ফ্রন্ট: বাংলাদেশে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই কৃষক ফ্রন্ট রয়েছে। কৃষক ফ্রন্ট অধিকাংশ সময়েই অন্ধভাবে তাদের মূল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করে থাকে।
১৩. শ্রমিক ফ্রন্ট: বাংলাদেশে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই শ্রমিক ফ্রন্ট রয়েছে। শ্রমিক ফ্রন্ট অধিকাংশ সময় অন্ধভাবে মূল রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মসূচি সমর্থন করে থাকে।
১৪. ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল: বাংলাদেশের অনেক দলই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কিছু কিছু ব্যক্তি বিশেষ করে কোন সামরিক জেনারেল হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁকে ঘিরে একটি স্তাবক গোষ্ঠী তৈরি হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দলত্যাগী রাজনৈতিক নেতাগণের সমর্থনে এসব ব্যক্তি একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেন। এই দলই তার ক্ষমতাকে বৈধ ভিত্তি প্রদান করে। এরূপ ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলের নিকট রাজনৈতিক আদর্শ অপেক্ষা বিশেষ ব্যক্তিই অনেক বড় বা মূল ভরসা।
উপসংহার: উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। পৃথিবী উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ব্যবসার অনেক বৈশিষ্ট্যই লক্ষ করা যায় না। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্যই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক সংকট ও স্থিতিহীনতা স্থায়ীরূপ পরিগ্রহ করেছে।