ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পটভূমি, গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর।

৭ই মার্চের ভাষণের পটভূমি, গুরুত্ব ও তাৎপর্য 

আজ আমরা পেয়েছি স্বাধীন ভূমি, পেয়েছি নিজেদের অধিকার, পেয়েছি লাল-সবুজের দেশ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বাঙালির ইতিহাসে অনেকগুলো দিন আছে, যা আমাদের মনে রাখতে হবে ৷ ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন৷ ভাষণটি শুরু হয়েছিলো ২ টা ৪৫ মিনিটে এবং শেষ হয়েছিলো বিকাল ৩ টা ৩ মিনিটে । এই ১৮ মিনিটের ভাষণ ই যেনো জাগিয়ে তুলেছিলো স্বাধীনতার স্বপ্ন। ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক- মেশিনের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ দিন বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন_

"এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। 
এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

৭ই মার্চের পটভূমি:

তারিখ হিসেবে ৭ মার্চ ঐতিহাসিকতার মর্যাদা হঠাৎ করে পায়নি। পেছনে তাকালে চোখে পড়বে বিস্তর এক শোষণ ও পরাধীনতার গল্প, যে গল্পের সূচনা হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। যেদিন বাংলাকে খণ্ডিত করে উপ মহাদেশীয় রাজনীতির রথী-মহারথীগন 'খেললেন 'ভাগ বাটোয়ারার খেলা। দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভারতকে ভাগ করে সৃষ্টি করা হলো নতুন একটি দেশ- পাকিস্তান।

তৎকালীন পাকিস্তান আবার বিভাজন করা হলো দুই ভাগ্নে, পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান। তখন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচার এবং নির্যাতন করে আসছিলো। তারা পূর্ব বাংলার মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা তা মেনে নেয়নি তারা 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' এই মর্মে সংগ্রাম করেছিলো। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন শফিক, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরো নাম না জানা অনেকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহীনি তবুও থেমে থাকে নি। তারা একের পর এক ষড়যন্ত্রের মালা গেঁথেছিলো বাঙালিদের বিরুদ্ধে। বাংলার সম্পদ তারা কেড়ে নিতে শুরু করল। ফলে পূর্ব বাংলার আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। পশ্চিমা আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে বাংলার উন্নয়ন মন্থর গতি লাভ করল এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিটি মন্ত্রক ও দপ্তরে বাঙালিরা চরম বৈষম্যের শিকার হলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বাঙালিদের শোষণ করা শুরু করলো পশ্চিমারা। ক্ষোভ দানা বাধতে শুরু করল। শুরু হলো ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক বিক্ষোভ, অসহযোগ আন্দোলন ।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে পেশ করলেন “বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা। পাকিস্তানের রাজনীতিকেরা সেটি ভালো চোখে দেখেননি। ১৯৬৯ সালে শুরু হলো স্বৈরাচারী আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনে যোগ দিলো দুই পাকিস্তানের সকলে ফলে তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ লাভ করে এবং আইয়ুব খান তার গদি ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর সেই জায়গা দখল করেন ইয়াহিয়া খান । শুরু হয় আরেক স্বৈরাচারী আমল।

ইয়াহিয়া খান আন্দোলনের তীব্রতায় ঘাবড়ে যেয়ে ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে দায়িত্ব দিতে অস্বীকার করেন। ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে আকৃষ্ট করতে তিনি ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।

৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ দিক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৭ ই মার্চের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো 

১. দেশের পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা ৷ 

২. তাঁর নিজ ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা করা।

৩. পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা।

৪. সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহ্বান।

৫. অত্যাচার ও সামগ্রিক আগ্রাসন মোকাবিলার

হুমকি।

৬. দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা।

৭. নিগ্রত ও আক্রমণের প্রতিরোধের আহ্বান।

উপযুক্ত সময়ে সঠিক দিকনির্দেশনাঃ

৭ই মার্চের ভাষণকে বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক দিকনির্দেশনা । পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহা দেখেই আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ বুঝতে পেরেছিলেন যে কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে জাতীয় পরিষদে সরকার গঠন করতে দেবে না পশ্চিমারা । দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে পড়ে। নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণাও দিতে পারছিলো না আবার পাকিস্তানিদের অত্যাচার সহ্য করাটাও ছিল কঠিন । সেজন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ নির্দেশনা মূলক ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত 'নিলেন ভাষণের শেষের দিকে ছিলো তার নির্দেশমালা। তিনি বললেন_

“ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে...।”

তাঁর এই ভাষণে তিনি আরো বলেন,

"তোমরা আমার ভাই... আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমায়ে রাখতে পারবে না।”

''মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

৭ই মার্চের গুরুত্ব ও তাৎপর্য :

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস। সম্ভবত পৃথিবীতে অন্য কোনো ভাষণ এতবার উচ্চারিত হয়নি। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও অশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ঐ ভাষণের দিক-নির্দেশনাই ছিলো সে সময় বজ্র কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ৷ বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ একটি জনগোষ্ঠীর মুক্তির এক মহাকাব্য এ ভাষণে তাঁর তেজস্বিতা ও সম্মোহনী ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে। এ ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। এ ভাষণ মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলে। এ ভাষণ ছিলো বহুমাত্রিকতায় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শুধু বাঙালির জন্যই নয়, বিশ্বমানবতার জন্যও অবিস্মরণীয়, অনুকরণীয় এক মহামূল্যবান দলিল ৷ ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটিই স্বীকৃত হয়েছে। গণতন্ত্র, উচ্চ মানবিকতা, ত্যাগ ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, জাতিভেদ-বৈষম্য ও জাতি-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতার মুক্তির সংগ্রামে যুগে যুগে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগাবে৷ সাধারণ নাভারিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী | সবার জন্যই এ ভাষণে অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ হওয়ার কারণ :

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে । কোনো ধরনের আপোসের পথে না গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে, যা বিশ্ব ইতিহাসে নজীরবিহীন । বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের পিছনে যে বড় শক্তিটি কাজ করছিলো তার অনেকটা অংশই ছিল ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলার মানুষ সেই ডাকেই গর্জে উঠেছিল, সেই ডাকেই অস্ত্র ধরেছিলো, সেই ডাকেই নিজের অধিকারকে চিনতে শিখেছিলো ৷ সেই ভাবেই ভেঙে ছিলো পরাধীনতার শৃঙ্খল ।

আজ যখন কিশোরীর হাতে পতাকা দেখি গবে বুক ভরে উঠে 'কিন্তু কেউ কি হিসাব করেছি এমন কতো কিশোরীর ঘ্রাণ অকুলেই ঝরে গেছে ৷ আব্দুল লতিফ তাই বলেছেন

"আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়। আমি দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি জানা আছে জগতময়।”

শ্রেষ্ঠ ভাষণের আরেকটি কারণ হচ্ছে, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ দেশাত্মবোধ, 'সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির এবং লক্ষ্য অর্জনে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ৷ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মূল লক্ষ্য ছিলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ শাসন-শোষণ থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি । এ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সময়ের পরিসীমায় আবদ্ধ না হয়ে তা হয় কালোত্তীর্ণ ও প্রেরণাদায়ী। এই ভাষণের আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর কাব্যিক গুণ-শব্দশৈলী ও বাক্যবিন্যাস, যা হয়ে ওঠে গীতিময় ও চতুর্দিকে অনুরনিত৷ যে কোনো শ্রেষ্ঠ ভাষণই উত্থিত হয় বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে, ফলে তা তাৎক্ষনিক, স্বতঃস্ফুর্ত ও হৃদয় উৎসারিত বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণও ছিল তাই, যা লিখিত ছিল না। এ ভাষণের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি আকারে ছিলো নাতিদীর্ঘ।

১৮৬৩ সালে আমেরিকার ১৬ তম প্রেসিডেন্ট আব্রা হাম লিংকন এর ভাষণ এর শব্দ সংখ্যা ২৭২ এবং সময় ৩ মিনিটের কম৷ ভাষণটি ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ও লিখিত যা ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়।

অপরদিকে আফ্রো-আমেরিকান মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিংয়ের বিখ্যাত ভাষণের সময়কাল ছিলো ১৭ মিনিট এবং শব্দসংখ্যা ১৬৬৭ । ভাষণটির প্রথমাংশ লিখিত ও পঠিত যার শ্রোতার সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণ ছিল ১৮ মিনিট ব্যাপী, শব্দ সংখ্যা ১৯৩৫। যেটি ছিলো তাৎক্ষণিক, স্বতস্ফুর্ত ও অলিখিত। এ ভাষণের প্রতিটি শব্দ নির্বাচন করা হয়েছিলো অতন্ত সুচিন্তিত - ভাবে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনের নিরিখে। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিলো তার হৃদয় ভাঙীর থেকে উৎসারিত।

উপসংহার: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভাষণ এদেশের জনগণকে দারুনভাবে আন্দোলিত করে এবং মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে । ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার চূড়ান আহ্বানটি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এ ঘোষণা মুক্তিকামী মানুষের কাছে লাল-সবুজ পতাকাকে মূর্তিমান করে তোলে। আর এরই মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয় । জাতির জনকের এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়েই দেশব্যাপী সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ নয়মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করি বহু কাঙ্ক্ষিত “সোনার বাংলাদেশ”।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url