দুর্নীতি কিভাবে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে আলোচনা কর।
ভূমিকা: বর্তমানে যে কোন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামনে দুর্নীতি ও সহিংসতা বা সন্ত্রাস একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা ক্রমশ বৃদ্ধির ফলে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গন ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পুরােমাত্রায় ধ্বংস করে দিতে এ দুটি প্রত্যয়ের ক্ষমতাই সর্বাধিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে। পৃথিবীর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ এর ক্ষতিকর প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষকরে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ দুর্নীতি ও সহিংসতার কালাে থাবায় বিপর্যস্ত। অথচ দুর্নীতি ও সহিংসতার রাজনৈতিক আবর্তনে একবার নিমজ্জিত হয়ে তা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এমন দেশের সংখ্যা বর্তমান বিশ্বে খুব কমই আছে। দুর্নীতি ও সহিংসতা সরকারি উন্নয়ন পরিকল্পনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে জনগণের সম্পদকে ব্যক্তিগত খাতে ব্যবহার করার প্রবণতা জাগায়।
দুর্নীতি কিভাবে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে
উন্নয়ন একটি ব্যাপক ধারণা। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রতিক্ষেত্রেই উন্নয়নের ধারণা বর্তমানের কেন্দ্রবিন্দু। উন্নয়নশীল বিশ্বে সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন অর্জন একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। উন্নয়নশীল বিশ্বে দুর্নীতি ও সহিংসতা বিভিন্নভাবে উন্নয়নের গতিকে মন্থর করে যাকে প্রধান না হলেও অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে :
১.আমলাদের দুর্নীতি: প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করে একটি দেশের সরকারি নীতি ও উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব আমলাদের উপর। কিন্তু সরকারি বেসরকারি অফিসে কর্মরত অফিসাররা আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুস গ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। ফলে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়।
২.আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়: গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান কাজই হলাে আইনশৃঙ্খলার যথাযথ বাস্তবায়ন করে জনগণের জানমালে নিশ্চয়তা বিধান করা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুর্নীতি ও ঘুসের আশ্রয় নিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যায়। ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।
৩.শিল্পায়নের গতিকে মন্থর করে: একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিহার্য। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে। শিল্পায়নের প্রয়ােজনীয়তা। শিল্পায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলাে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি। কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। গড়ে তুলতে চাইলে সরকারি অনুমতি নিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এতে বিনিয়ােগকারীরা তাদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে । এসব দুর্নীতির পাশাপাশি হরতাল, ধর্মঘট, শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি রয়েছে যা উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
৪. শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে: একটি দেশের উন্নয়নের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ তার নিজ অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয় । কিন্তু দুর্নীতি ও সন্ত্রাস আজকের শিক্ষাঙ্গনকে করছে কলুষিত। শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুস ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করে অযােগ্য লােকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে। নিয়ােগ দান করে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া একজন শিক্ষককে একস্থান থেকে অন্যস্থানে বদলি করতে উৎকোচ গ্রহণ করা হয়।
৫.বিচার ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করে: কোন দেশের বিচার ব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাহলে সে দেশ ধ্বংস হতে বাধ্য। উঁচু শ্রেণির লােকেরা খুন, জখম, রাহাজানি ও বিভিন্ন অসৎ কাজ করে ও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যায়। বিভিন্ন সময় দেখা যায় বিচারকরা দুর্নীগ্রিস্ত হয়ে পড়ছে এবং পরবর্তীতে তারা পদত্যাগে বাধ্য হয়। এখানে বিচারের বাণী নীরবে কাদে। এদেশের সাধারণ জনগণ সঠিক বিচার পায় না।
৬.সেবামূলক সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে: সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন - ওয়াসা, ডেসা, টিএন্ডটি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে নিয়ােজিত কর্মচারীরা দুর্নীতির মাধ্যমে একদিকে সরকারের টাকা আত্মসাৎ করে অপরদিকে জনগণকে হয়রানি করে। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ডের তদন্ত করলে দেখা যায় যে, দুর্নীতি দমন ব্যুরাে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
৭. সরকারকে শুল্ক থেকে বঞ্চিত করে: যারা বাড়িঘর বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের আয়কর বা ট্যাক্স দিতে হয়। কিন্তু আয়কর অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর যােগসাজশে করদাতা বিলুপ্ত পরিমাণ কর ফাঁকি দেয়। ফলে সরকার অর্থের অভাবে জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় যার ফল ভােগ করে অসহায় জনসাধারণ।
৮.রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি: রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভােটের আগে কোটি টাকা খরচ করে। জনগণের কাছে ভােট ভিক্ষা চায় । ক্ষমতায় যাওয়ার পর জনসেবার নামে তারা সরকারি সম্পদ লুটে খায় এবং সেই সাথে বাইরে পাচার করে। যেমন- এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে নয় বছরব্যাপী আন্দোলনের বড় অভিযােগ ছিল দুর্নীতি। এজন্য তিনি স্বল্প সময় কারারুদ্ধ ছিলেন কিন্তু তার সহযােগীরা সরকার কিংবা বিরােধীদলের সাথে আঁতাত করে মুক্ত থেকেছে।
৯. গণতান্ত্রিক সমাজ ও স্থিতিশীল সরকারের অন্তরায়: জনগণের সাথে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বরখেলাপ, রাষ্ট্রীয়। সযােগ সুবিধাকে নিজেদের দল ও সমর্থকদের স্বার্থে কাজে। লাগানাে, জনগণের সাথে প্রতারণা, সরকার ও বিরােধী নেতার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, ঐকমত্যের অভাব, সহিষ্ণুতার অভাব ইত্যাদি রাজনৈতিক দুর্নীতির পরিচয় বহন করে। এ ধরনের দুর্নীতি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও স্থিতিশীল সরকারের অন্তরায়।
১০.প্রশাসনিক দুনীতি: অধিকাংশ সরকারি সংগঠনই এখন বিশৃঙ্খলা, দুনীতি, নিয়মহীনতা অযােগ্যতা প্রভৃতি কঠিন পীড়ায় পীড়িত। প্রশাসনকে ঘুস না দিয়ে চাকরির কথা ভাবা যায় না। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুনীতি আজ উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে আমলারা। তারা প্রশাসনিক কাঠামাের উন্নয়নের চেয়ে নিজেদের আখের গােছাতেই বেশি ব্যস্ত। প্রশাসনিক দুনীতির প্রভাব পড়ছে সমাজের সর্বস্তরে বিশেষকরে শিক্ষিত বেকার যুবকরা যােগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতির কবলে পড়ে যােগ্য চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
১১.অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করছে। মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্য বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা আদায় প্রবণতা, চোরাকারবারি, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, রেশন কারচুপি ও রেশনের খাদ্যদ্রব্য বণ্টন না করে গােপনে বিক্রি করে দেয়া ইত্যাদি দুর্নীতির মাধ্যমে মধ্যস্বত্ব। ভােগীরা কালাে টাকায় রাতারাতি ধনী হচ্ছে। ফলে জাতীয় মূলধন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে।
১২.ধর্মীয় ক্ষেত্রে দুর্নীতি: ধর্মীয় ক্ষেত্রও আজ দুর্নীতি মুক্ত নয়। জনসাধারণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিকে আশ্রয় করে স্বার্থসিদ্ধি, বিভিন্ন ধরনের রােগমুক্তি ও মনােবাঞ্ছা পূরণে ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে ধোকাবাজি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানাে ইত্যাদি দুর্নীতির মাধ্যমে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, সন্ত্রাস হলাে সশস্ত্র দুর্নীতি আর দুর্নীতি হলাে নিরস্ত্র সন্ত্রাস। একটি অপরটির সাথে জড়িত। সন্ত্রাস হলাে দুর্নীতির সম্প্রসারিত রূপ। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি উভয়ই বিভিন্নভাবে মানবসমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। তাই সন্ত্রাস ও দুর্নীতি কোন সভ্য সমাজের মঙ্গল বয়ে আনয়নের জন্য সমাজ থেকে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নামক কীটকে চিরতরে বিদায় করতে হবে। কোনক্রমেই দুর্নীতিবাজ সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের প্রতিটি সাধারণ জনগণকে এ ব্যাপারে সচেতন ও সােচ্চার হতে হবে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজদের ভয় না পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জনগণের চেয়ে বড় শক্তি আর নেই। তাই জনগণই পারে সমাজের অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করার প্রচেষ্টা চালাতে।