বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস

বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
 
বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ পৃথিবী সৃষ্টির সঠিক দিনক্ষণ, পৃথিবীতে মানুষের প্রথম আবির্ভাবকাল যেমন সঠিকভাবে বলা যায় না, তেমনি ভাষা সৃষ্টির সঠিক দিনক্ষণ সম্পর্কেও বলা যায় না। তবে ভাষাতত্ত্ববিদরা বিভিন্ন ভাষার লক্ষণ, উচ্চারণ, লেখার ধরন, সাহিত্যের উপস্থাপন ইত্যাদি নানা দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে তাঁদের মতামত পেশ করেছেন এবং বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে একটা ধারণা দিয়েছেন। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার এখন যে রূপ প্রচলিত, প্রাচীনকালে কিংবা একশ বছর আগেও এমনটা ছিল না। এমনকি ভবিষ্যতেও এমনটা থাকবে না। তাই বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে এই উপমহাদেশের যে দুজন পণ্ডিতের সিদ্ধান্ত সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও আলোচিত তাঁদের মতামত সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

> ভাষাপণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায় ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে।

অন্যদিকে,
> ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়।

'চর্যাপদ' বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য নামে একশ্রেণির সন্ন্যাসীর রচিত এসব পদ ছোট আকারের কবিতা বা গান। চর্যাপদের এই গানগুলোকে সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত বলে ধারণা করা হয়। চর্যাপদের রচনাকাল অনুমান করেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কাল নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। চর্যাপনের প্রথম কবি মীননাথের আবির্ভাবকাল বিবেচনা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি অনুমান করেছেন।

বাংলা ভাষার মূল অনুসন্ধান করে পণ্ডিতরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাগোষ্ঠী থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫,০০০ বছর আগে পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার পশ্চিমে যে ভাষা প্রচলিত ছিল তা-ই ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা নামে পরিচিত। এর দুটি শাখা- কেন্তম ও শতম। শতম শাখার অন্যতম উপশাখা হলো ইন্দো-ইরানীয় বা আর্য। এই আর্য শাখার আদিম রূপ প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার আনুমানিক সময়কাল খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১,৫০০ থেকে ১,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সংস্কৃত এ সময়ের একটি সাহিত্যিক ভাষা এবং তা শুধু সমাজের উঁচু শ্রেণির লোকের মাঝে প্রচলিত ছিল। তখন সাধারণ মানুষের মাঝে ভাষার যে আলাদা রূপ প্রচলিত ছিল তার নাম প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্য ভাষা বা আদিম প্রাকৃত ভাষা। এই ভাষা অনেক বিস্তার লাভ করেছিল বলে বিভিন্ন অঞ্চলে তার রূপভেদ ছিল। পালি ভাষা ঐ সময়ের একটি ভাষারূপ। এর পরবর্তী রূপ প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত এবং পরবর্তী পর্যায়ে গৌড়ীয় প্রাকৃত।

পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, “গৌড়ীয় প্রাকৃতের পরবর্তী স্তর গৌড়ীয় অপভ্রংশ। এ অপভ্রংশ থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।"

অন্যদিকে, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন মনে করেন, মাগধি অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। তাঁদের ধারণা, প্রাচীন ভারতীয় আর্য বা বৈদিক কথ্য ভাষা থেকে প্রাকৃত ভাষার জন্ম। এ প্রাকৃতকে বলা হতো প্রাচ্য অঞ্চলের কথ্য ভাষা। পরবর্তী সময়ে এ প্রাকৃত থেকে জন্ম নেয় মাগধি প্রাকৃত এবং মাগধি প্রাকৃত থেকে জন্ম নেয় মাগধি অপভ্রংশ। আর সেই মাগধি অপভ্রংশ থেকেই জন্ম নেয় আমাদের বাংলা ভাষা। 

জেনে রাখা ভাল 

আধুনিক বাংলা ভাষা বঙ্গ অঞ্চলের ভাষার প্রায় দুই হাজার বছরের অবিরাম বিবর্তনের ফসল। প্রাচীনতম সাহিত্যিক ভাষা নানাবিধ বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্য হয়েছে প্রাকৃত ভাষা হতে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে। প্রাকৃত শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বাভাবিক।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url