মুদ্রাস্ফীতি কি? মুদ্রাস্ফীতি কেন হয়? মূদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়।

মূদ্রাস্ফীতি কাকে বলে?

যখন সময়ের ব্যবধানে পণ্য বা সেবার মূল্য টাকার অঙ্কে বেড়ে যায় তখন তাকে অর্থনীতির ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি বলে। সাধারণত পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ঐপণ্য ক্রয়ে বেশি পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন কিংবা একই পরিমাণ মুদ্রা দিয়ে আগের পরিমাণ পণ্য কিনতে গেলে পরিমাণে কম পাওয়া যায়। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়।


মুদ্রাস্ফীতি কেন হয়? মুদ্রাস্ফীিতির কারণ কি?

মুদ্রাস্ফীতি সাধারণত দুটি কারণে হয়ে থাকে। যথাঃ 

১) চাহিদা জনিত এবং 
২) মূল্য জনিত।

চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি কেন হয়?

উভয়ই, যেকোন দেশের অর্থনীতিতে মূল্য বৃদ্ধির জন্য সমান ভাবেই দায়ী, তবে ভিন্ন ভাবে কাজ করে। যখন কোন পণ্যের চাহিদা গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়ে যায় তখন “চাহিদা জনিত” কারণে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। অন্যদিকে পণ্যের সরবরাহ ব্যয় বেড়ে গেলে মূল্য জনিত মূল্যবৃদ্ধি হয়। চাহিদা জনিত মূদ্রাস্ফীতি চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি পণ্যের ক্রম বর্ধমান দামের সবচেয়ে বড় কারণ। চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি তখনই ঘটে যখন পণ্য বা পরিষেবার জন্য ভোক্তার চাহিদা এত বেশি বেড়ে যায় যে এটি সরবরাহের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। যে সকল পরিস্থিতি চাহিদা জনিত মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে। সেগুলো নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

মানুষের হাতে যখন অতিরিক্ত অর্থ চলে আসে এবং এর ফলে তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কালোবাজারি যত হবে জিনিসের দাম তত বাড়ে। বাংলাদেশ এবং ভারতে প্রায়ই খাদ্য শস্যের মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায়, এর অন্যতম কারণ কালোবাজারি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সরকারের খরচ বৃদ্ধি। এর ফলে সেই টাকা টা জনগণের পকেটে আসে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত “ফিসকাল স্টিমুলাস” বা অর্থনৈতিক ভর্তুকি দিলে জিনিসের দাম বাড়ে। সরকারের বৈদেশিক বাণিজ্যিক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

মুদ্রাস্ফীতি মানে অনেক টাকা বাজারে ঘুরছে। সেক্ষেত্রে (ডলারের সাপেক্ষে) টাকার দাম কমবে। টাকার মান ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই টাকা ছাপাতে পারে না। সুতরাং, গ্রাহকরা যখন অতিরিক্ত ব্যয় যোগ্য অর্থ আয় করেন তখন চাহিদাজনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। মানুষের হাতে ব্যয় করার জন্য অতিরিক্ত অর্থের যোগান থাকলে তখন মানুষ আরও পণ্য এবং সেবা ক্রয় করতে চায় এবং তাদের সেই ক্ষমতা থাকে।

মূল্য জনিত মূদ্রাস্ফীতি কেন হয়?

যখন বাজারে কোন পণ্যের অতিরিক্ত চাহিদার সৃষ্টি হয় এবং তার সাথে যৌথভাবে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়, তখন সেই পরিস্থিতিতে প্রস্তুতকারককে পণ্য বা পরিষেবার দাম বাড়ানোর একটি সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় এবং মূল্যজনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। তবে মূল কারণ হলো- যখন কোনো জিনিস তৈরি করতে যে সামগ্রীগুলো লাগে তার দামের যখন বৃদ্ধি পায়, তখন সামগ্রিকভাবে দ্রব্যটির মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।

কোনো দ্রব্য উৎপাদন করতে সাধারণত চারটি বস্তু লাগে। যথা- Land, Labor, Capital and Entrepreneur. একে আমরা বলি থাকি “ফ্যাক্টর অব প্রডাকশন”। এই সব মিলিয়ে যে খরচটা হয়, সেটাকে বলে "ফ্যাক্টর কস্ট”। ফলে এখানে যদি কোনো কিছুর দাম বাড়ে, তাহলে ওই ফ্যাক্টর ব্যয়ও বাড়বে। পাশাপাশি সেই দ্রব্যটি যখন বাজারে আসে তখন তার ওপর সরকার চাপায় পরোক্ষ কর। তারপর সেটার বাজারি মূল্য (“মার্কেট প্রাইস”) ঠিক হয়। এবার যদি সরকার ট্যাক্স বাড়ায় তাহলেও জিনিসের দাম বাড়বে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম বৃদ্ধিও অন্যতম কারণ হতে পারে। খনিজ তেলের দাম বাড়া মানেই ট্রান্সপোর্ট বাপরি বহনের দাম বেড়ে যাওয়া। পাশাপাশি আরো যে সকল কারণে মূল্য জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে পারে।

১। মজুরি মূল্যবৃদ্ধি যা বেতন বৃদ্ধি করে।
২। এক চেটিয়া বাজার তৈরির ক্ষমতাও মূল্য জনিত মুদ্রাস্ফীতির কারণ।
৩। প্রাকৃতিক দুর্যোগ উৎপাদনের পরিকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ করে সাময়িক ভাবে মূল্য জনিত মূল্যস্ফীতি তৈরি করে। 
৪। ক্রমাগত প্রাকৃতিক সম্পদের সংস্থান হ্রাসও মূল্য জনিত মুদ্রাস্ফীতির ক্রম বর্ধমান কারণ। 
৫। তাছাড়া, যখন কোনও দেশ তার মুদ্রার বিনিময় হার কমায়, তখন তা আমদানিতে মূল্য জনিত মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করে।

অর্থাৎ, পণ্য সরবরাহ হ্রাস পেলে বাজারে তা একটি ঘাটতি সৃষ্টি করে এবং ফলে মূল্য জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। উৎপাদকরা তাদের পণ্য বা পরিষেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে দাম বাড়ায়।

মূদ্রাস্ফীতিতে কারা লাভবান হয়? মূদ্রাস্ফীতিতে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়?

মুদ্রাস্ফীতির ফলে চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত, যাদের উপার্জন নির্দিষ্ট তারা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেনাদাররা অর্থাৎ যে ঋণ নিয়েছে সে লাভবান হয় এবং পাওনাদার বা ঋণদাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরকারণ এই সময় দেনাদাররা তাদের সম্পত্তি বা উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে আগের চেয়ে বেশি আয় করে,সেই অর্থ দিয়ে তারা ধারশোধ করতে পারে। অন্যদিকে পাওনাদাররা যে অর্থ ফেরত পায়, তার ক্র‍য় ক্ষমতা আগের চেয়ে কমে যায়।

যারা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে, তারাই এই সময়ে লাভবান হয়, কারণ শেয়ারের দাম বাড়ে কিন্তু যারা নির্দিষ্ট সুদের হারে গভর্ণমেন্ট সিকিউরিটি বা ডিবেনচারে বিনিয়োগ করে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়

কোনো দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সেই দেশের সরকার একসাথে পরিকল্পনা স্থির করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারা গৃহীত পরিকল্পনাকে বলা হয় “মানিটরি পলিসি” (Monetary Policy) এবং সরকারের দ্বারা গৃহীত পদক্ষেপগুলিকে বলা হয় ” ফিসকাল পলিসি”(Fiscal Policy)।
যখন মুদ্রাস্ফীতি খুব বেড়ে যায়,অর্থাৎ সাধারণত বাজারে প্রচুর টাকার আগমন ঘটে, তখন ঐ দেশের রিজার্ভ ব্যাংক “ব্যাংক রেট” বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে অন্যান্য ব্যাংকগুলোও তাদের প্রদেয় বিভিন্ন ঋণের সুদের পরিমান বাড়াতে বাধ্য হয়। এদিকে ব্যাংকগুলোকে বেশি টাকা সুদ দিতে হলে ঋণ নেওয়ার প্রতিও মানুষের চাহিদা কমে। এছাড়া আগেকার ঋণশোধ করতে তাদের অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়। সব মিলিয়ে ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। আবার যখন মুদ্রাস্ফীতির হার ঋণাত্মক অর্থাৎ বাজারে টাকার জোগান কমে যায়, তখন রিজার্ভ ব্যাংক “ব্যাঙ্ক রেট” কমিয়ে দেয়। 

এছাড়া বাজার থেকে গভর্ণমেন্ট সিকিউরিটি কিনে বিনিময়ে নগদ অর্থ প্রদান করে। অন্যদিকে সরকারও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করে। যেমন, অপ্রত্যক্ষ করের জন্য জিনিসের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে সরকার করের বোঝা লাঘব করতে পারে।
Next Post Previous Post
1 Comments
  • Nipa Mojumder
    Nipa Mojumder ০১ আগস্ট

    I have some problem in this topic.but now i fully understand all the issues to my problems. Thank you for sharing this topic to us.

Add Comment
comment url