চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেতিবাচক এবং ইতিবাচক প্রভাব/ফলাফল

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, ১৭৯৩


ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রত্যেক জেলায় একজন ইংরেজ কালেক্টর নিয়োগ এবং নিলামে রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি প্রবর্তন করেন এবং সর্বোচ্চ নিলাম ডাককারীকে পাঁচ বছরের জন্য রাজম আদায়ের ঠিকাদারী প্রদান করেন। কিন্তু ৫ বছর অতিক্রম হবার পূর্বেই তিনি এই প্রথার কুফল লক্ষ করে একসনা বন্দোবস্তের নীতি প্রবর্তন করেন। উভয় ব্যবস্থাতেই বেনিয়া ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোকই রাজস্ব আদায়ের ঠিকাদারী লাভ করে। এভাবে একসালা' ও “পাঁচসালা বন্দোবস্তের ফলে বেনিয়া রাজস্ব ঠিকাদারদের অত্যাচারে বাংলার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।



লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৮৬ সালে গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজস্ব আদায়ের বিষয় নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনার পর ১৭৯০ সালে জমিদারদের সাথে আপাতত দশসনা বন্দোবস্ত করেন এবং বিষয়টি চিরস্থায়ী করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক বোর্ডের অনুমতি চেয়ে পাঠান। পরিচালক বোর্ড ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ কর্নওয়ালিশের দশসনা বন্দোবস্তকে "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে ঘোষণা করেন। জমির উপর ক্ষমতা, মালিকানা, এমনকি হস্তান্তর, পত্তন ও ইজারা দেওয়ার ক্ষমতাও এর ফলে জমিদাররা লাভ করলেন। তবে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে জমিদাররা রাজস্ব কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে জমি নিলামে বিক্রির অধিকার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে থেকে যায়। এজন্য একে "সূর্যাস্ত আইন' বলা হয়ে থাকে। এই আইনের বলে পূর্বে যারা নবাবী আমলে শুল্ক আদায়কারী ছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে যারা কোম্পানির বেনিয়া ও দালালি করে নগদ অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন তারাই জমিদারি ক্রয় করে নতুন জমিদার হয়ে বসলেন। এই নতুন জমিদাররাই পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজের বশংবদ শ্রেণীতে পরিণত হয়।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেতিবাচক এবং ইতিবাচক ফলাফল/প্রভাব

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী এবং তা নিম্নরূপ :

ক. নেতিবাচক প্রভাব/ফলাফল

১. আজ্ঞাবহ নব্য জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের লক্ষ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ রাজতন্ত্র একটি বশংবদ শ্রেণী তৈরি করা।" চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এরূপ একটি আজ্ঞাবহ জমিদারশ্রেণী দ্রুত গড়ে ওঠে।

২. মুসলমান জমিদার শ্রেণীর সর্বনাশ সাধন : ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৯৩ সালের মধ্যে অনেক মুসলমান জমিদারের জমিদারি ইংরেজ বিরোধিতার জন্য কেড়ে নেওয়া হয়। তাছাড়া নিলামে জমিদারি কেনাবেচার প্রচলন ঘটলে নব্য হিন্দু বেনিয়া ও ব্যবসায়ী শ্রেণী নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা প্রদানে ব্যর্থ মুসলমান জমিদারদের জমিদারি কিনে নেয়। ফলে মুসলমান জমিদারদের অনেকেই তাদের জমিদারি হারান এবং একশ্রেণীর নব্য হিন্দু বণিক শ্রেণী ইংরেজদের বশংবদ জমিদাররূপে আবির্ভূত হন।

৩. রাজস্ব ও শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব বদল: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ক্রমে রাজস্ব ও শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে চলে যায়।

৪. প্রজা নির্যাতন : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারদের ক্ষমতা ও দাপট বৃদ্ধি পায়। বিত্তশালী জমিদারগণ তাদের নায়ের, গোমস্তাদের উপর জমিদারির ভার অর্পণ করে বড় বড় শহরে গিয়ে অবস্থান করতে থাকেন। জমিদারদের অনুপস্থিতিতে প্রজাদের উপর নায়েব গোমস্তাদের অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

৫. কোম্পানির রাজস্ব ক্ষতি : পরবর্তীকালে জমির মূল্য বৃদ্ধি পেলেও সরকারের আয় বৃদ্ধি পায়নি। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্ধিত রাজস্বের লভ্যাংশ হতে বঞ্চিত হন।

৬. শাসক ও শাসিত জনগণের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট নব্য জমিদারগণই মুলত নির্দিষ্ট এলাকার রাজস্ব আাদায়কারী এবং শাসকে পরিণত হন। কৃষক-প্রজাদের সাথে কোম্পানির সরকারের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বা যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার কৃষক প্রজাদের বাস্তব অসুবিধাগুলো জানতে পারতো খুব কমই। জমিদার ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারণেই কৃষক প্রজারা তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা সরকারকে জানাতে পারতো না। ফলে শাসক শাসিত জনগণের মধ্যে দূরত্ব বা ব্যবধান বুদ্ধি পায়।

৭. শিল্পে অনগ্রসরতা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এদেশের বিত্তশালী ব্যক্তিগণ বিশেষ করে ব্রিটিশ বেনিয়ানরা জমিদারি কেনায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। শিল্প-কারখানা স্থাপনের চিন্তা তাদের মাথায় প্রবেশ করেনি। তাছাড়া ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্যের সহজলভ্যতার ফলে এদেশীয় কুটির শিল্প বা হস্তশিল্প ধ্বংস হতে থাকে।


খ. ইতিবাচক প্রভাব/ফলাফল

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থের কথা চিন্তা করলে বলতে হয় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কিছু ইতিবাচক দিকও ছিল। সেগুলো নিম্নরূপ :

১. রাজস্ব বৃদ্ধি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রাজস্ব আয় নির্ধারিত হয় এবং বার্ষিক ভিত্তিতে আদায়ের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এর ফলে ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি পায় এবং কোম্পানির সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট হারে তা পাওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিত হন।

২. সরকার সমর্থক গোষ্ঠী: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইংরেজদের বশংবদ একটি জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। এরা সবসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারকে সহায়তা এবং অন্য আনুগত্য প্রদর্শন করে। কৃষক প্রজা বিদ্রোহ দমনে এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় জমিদারগণ ব্রিটিশ সরকারকে সহায়তা করে। এর ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত শক্ত হয়।

৩. জমির মূল্য বৃদ্ধি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যারা জমিদার হন তারা পতিত জমি, বিশাল বন জঙ্গলগুলো পরিষ্কার করে খাজনার বিনিময়ে প্রজাদের মাঝে বন্টন করে দেন। ফলে জমিদারের আয় বৃদ্ধি পায় এবং জমির মূল্য বৃদ্ধি পায়।

৪. উন্নয়নমূলক কাজ: জমিদারদের আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের অনেকেই নিজ জমিদারিতে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজও করতে সচেষ্ট হন। রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে সরকারও এসব কাজে উৎসাহ প্রদান করতে থাকে।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url