ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান, আকার ও আয়তনের গুরুত্ব
ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান, আকার ও আয়তনের গুরুত্ব আলোচনা কর।
ভূমিকা : ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থান আকার ও আয়তন একটি দেশের জাতীয় শক্তিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই অধ্যাপক মর্গেন থু বলেছেন, “ভৌগোলিক অবস্থানের সবচেয়ে স্থায়ী উপাদান হলো যার উপর কোনো দেশের জাতীয় শক্তি নির্ভর করে।” ভূরাজনীতি অধ্যয়নে ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রকৃতির গুরুত্ব এত বেশি যে, নেপোলিয়ান বলেছেন একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি তার ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে ।
ভূরাজনীতি কি?: ভূরাজনীতি হলো রাজনৈতিক ক্রিয়া, রাজনৈতিক শক্তি এবং ভৌগোলিক বিন্যাসের সম্পর্ক বিশ্লেষণ। ভূরাজনীতি হচ্ছে ভূগোলের অধ্যয়নের সেই অংশ, যা পররাষ্ট্রনীতি এবং রাজনৈতিক প্রপঞ্চসমূহের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। ভূরাজনীতি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার পারস্পরিক অবস্থানের সাবধানতার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করে থাকে ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে কৌশল হিসেবে কাজ করে থাকে। ভূরাজনীতি হলো - জ্ঞানের ক্ষেত্র এবং রাজনীতির সম্পর্কের সেই অংশ যা একটি - জাতির শক্তি সামর্থ্য নির্ধারণ করে জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।
ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান, আকার ও আয়তনের গুরুত্ব
ভূরাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান, আকার ও আয়তনের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা কোনো দেশের ভৌগোলিক দিকগুলো সেই দেশের জাতীয় শক্তিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোনো দেশের আয়তন ভূপ্রকৃতি, অবস্থান, জলবায়ু, আবহাওয়া প্রতিবেশী দ্বারা জাতীয় শক্তি নির্ধারিত হয়। ভূরাজনীতি কারণে একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্র থেকে অধিক শক্তিশালী হয়। ভূরাজনীতি দ্বারা জাতীয় চরিত্র, নৈতিক বল ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড রয়েছে। এ ভূখণ্ড ছোট হতে পারে আবার বড়ও হতে পারে। তাই স্বভাবতই প্রতিটি রাষ্ট তার ভূখণ্ড বা, বাস্তবতার ভিত্তিতে জাতীয় শক্তি নির্ধারণ করে থাকে। আর ভৌগোলিক বা কৌশলগত অবস্থানের মধ্যে রয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন, আকৃতি, ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ প্রভৃতি, যা ভূরাজনীতির অন্তর্ভুক্ত।
১. ভৌগোলিক অবস্থান : একটি দেশের জাতীয় শক্তি তার ভৌগোলিক অবস্থানের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করে। মর্গেস্থ (Morgenthau) বলেছেন, "The most stable factor upon which the power of a nation depend is obviously geography." এ প্রসঙ্গে নেপোলিয়ন বলেছেন, "The foreign policy of a country is determined by its geography." ইংলিশ প্রণালি দ্বারা ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ইংল্যান্ডের জাতীয় শক্তি এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়া থেকে বিশাল সমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ইউরোপ বা এশিয়া থেকে কোনো শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি আক্রমণ করতে পারে না। আধুনিক এ পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব অনেক হ্রাস পেলেও জাতীয় শক্তির একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে আজও স্বীকৃত রয়েছে। যেমন- রাশিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সে দেশকে প্রথমে বাল্টিক ও পরে কৃষ্ণ সাগরের দিকে এবং শেষে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে সম্প্রসারণ নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য করে। ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতির জন্য ব্যবহারের উপযোগী কোনো সামুদ্রিক বন্দর না থাকায় রাশিয়া এসব উপকূলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে ।
ভারতবর্ষের ইতিহাস ও বৈদেশিক নীতি ভৌগোলিক অবস্থান দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। হিমালয় দ্বারা ভারতের উত্তর সীমান্ত সুরক্ষিত হওয়ার কারণে বাইরের শত্রুর পক্ষে আক্রমণ করা যেমন কঠিন, তেমনি ব্যবসায় বাণিজ্য স্থাপন করাও দুষ্কর। চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তর সীমান্ত রাজনৈতিক সামরিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
২. আকার : রাষ্ট্রের আকার বা গঠন প্রণালি রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে বৃহদায়তন অথচ কমসংখ্যক দেশের সাথে সীমান্তসহ দৃঢ়ভাবে সংগঠিত রাষ্ট্রই শক্তির ক্ষেত্রে সুবিধা ভোগ করে। ফ্রান্সের মতো মাঝামাঝি আকারের দেশ, যা অনেকটা গোলাকৃতিবিশিষ্ট এবং যার রাজধানী মাঝখানে। এসব রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তি অত্যন্ত বেশি হয়।
৩. আয়তন : ভৌগোলিক আয়তনের উপরও একটি দেশের জাতীয় শক্তি নির্ভর করে। অবশ্য কেবল আয়তন দ্বারা জাতীয় শক্তি সম্বন্ধে ধারণা করা সম্ভব নয়। জাতীয় শক্তির অন্যান্য উপাদানের পরিপ্রেক্ষিতেই আয়তনের গুরুত্ব বিচার করা প্রয়োজন। আয়তনে বড় হলেই একটি দেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে না। যেমন- সাহারা অনেক বড় কিন্তু শক্তিহীন। আবার জাপান আয়তনে ছোট হয়েও রাশিয়ার মতো বৃহৎ দেশকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। কিন্তু ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের আক্রমণ এবং পরে হিটলারের আক্রমণ প্রতিহত করতে ভৌগোলিক আয়তন রাশিয়াকে বিশেষভাবে সাহায্য করে। আয়তনে বড় হওয়ার সাথে সাথে বৃহৎ জনশক্তি যদি দক্ষ হয় এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যদি উন্নত হয়, তবে জাতীয় শক্তি অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আয়তনে বড় এবং এ দেশকে জয় করা কঠিন বলে সহজে কোনো রাষ্ট্র তাকে আক্রমণ করতে চায় না। আবার বৃহদায়তন অনেক সময় দুর্বলতার কারণও হতে পারে। বৃহৎ রাষ্ট্রে জাতীয় ঐক্য সংহতি ও কার্যকরী প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থাপন করা কঠিন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, একটি রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তি নির্ধারণে ভূরাজনীতি অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে পৃথিবীর সকল দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আকার ও আয়তনের গুরুত্ব ব্যাপক। আর জাতীয় শক্তির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে ভূরাজনীতি (Geo politics) দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করতে বিশেষ সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। সেজন্য বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো ভূরাজনীতির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে।