ভূ রাজনীতি অধ্যয়নের তত্ত্ব সমুহ

ভূ-রাজনীতি অধ্যয়নের তত্ত্বসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা: ইংরেজি Geo-politics শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ভূ-রাজনীতি বা ভৌগোলিক রাজনীতি। এটি একটি রাজনৈতিক প্রপঞ্চ যা বিশ শতকের প্রথমনিকে বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবে উৎপত্তি লাভ করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের একটি অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ভূ-রাজনীতি তত্ত্ব। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের মূলভিত্তি এ ভূ-রাজনীতি তত্ত্ব উৎপত্তি লাভ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। তবে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এ তত্ত্ব সাম্প্রতিককালের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ঊনবিংশ শতকে ভূ-রাজনীতি তত্ত্বের উদ্ভব এবং বিকাশের কারণ কিছু শক্তিশায্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, জনগণের জীবনধারণ। সম্পদ আহরণ এবং শক্তি অর্জনের জন্য ভূমির নিশ্চয়তা এবং সেজন্য সম্প্রসারণ হচ্ছে ভূ-রাজনীতি তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। ভূগোল, রাজনীতি, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে পুঙ্খানপুষ্পভাবে গবেষণার মাধ্যমে যেসব তত্ত্ব গবেষকরা প্রদান করেছেন তাই ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব। 



ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্বসমূহ : ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে চিন্তার সূত্রপাত অনেককাল আগে থেকে হলেও রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ রাষ্ট্রসমূহের মাঝে শক্তির সম্পর্ক নিরূপণ এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভূ-রাজনীতির গুরুত্ব বৃদ্ধিপায় এবং এই কারণে বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে উনবিশ শতকে। ঐ সময় সাধারণ শক্তিসাম্য তত্ত্ব রক্ষণশীল মূলত শান্তি এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই ছিল প্রধান লক্ষ। আর সেজন্য ভূ রাজনৈতিক তত্ত্বে অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা নিহিত থাকে। ভূ রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শক্তির সম্পর্কের যে পরিবর্তন শান্তিপূর্ণ নাও হতে পারে। ভূ-রাজনীতি অধ্যায়নের জন্য যারা তত্ত্ব প্রদান করেছেন তাদের মধ্যে ফ্রেডরিক রেজেল, রুডলফ কিয়েলন, কাল হাউজফার প্রমুখ অন্যতম। নিম্নে ভূ রাজনীতি সম্পর্কে তাদের তত্ত্বসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. ফ্রেডরিক রেজেল এর তত্ত্ব: জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোলের অধ্যাপক রেজেল ১৯ শতকের মধ্যভাগে শক্তিধর জাতির উত্থানের পেছনে ভৌগোলিক বিবিধসমূহ ব্যাখ্যার প্রয়াস পান। ফ্রেডারিক রেজেল দার্শনিক হেগেলের মতবাদ গ্রহণ করে মত প্রকাশ করে যে “রাষ্ট্র হচ্ছে একটি জৈবিক সত্তা এবং মানবগোষ্ঠীর নিজেদেরকে একমাত্র তার সাথে একত্রে করে পরিপূর্ণতা পেতে পারে।" তার মতে রাষ্ট্র কখনো মানব সম্প্রদায়ের নিয়ম অনুযায়ী নৈতিক নিয়মাবলি মেনে চলতে পারে না। রেজেলের এ মতবাদ চার্লস ডারউইনের দ্বারা প্রভাবিত।

২. রুডলফ কিয়েলেন এর তত্ত্ব : রুডলফ কিয়েলেনকে আধুনিক ভূ-রাজনীতির জনক বলা হয়। তিনি ফ্রেডরিক রেজেলের ধারণাকে এক ধাপ উন্নত করে উপস্থাপন করেন। তার যতে, “রাষ্ট্র শুধু একটি জৈবিক সত্তা নয় বরং এটি একটি সচেতন সত্তাও, যার নৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য রয়েছে। তিনি ভূ রাজনীতির জৈবিক ও গতিধারার তত্ত্বের আলোকে এ কার্যক্রম পরিচালনার পক্ষপাতী ছিলেন।

৩. আলফ্রেড টি ম্যাহান এর তত্ত্ব: তিনি ছিলেন আমেরিকার একজন বিখ্যাত রণকৌশল বিশারদ, নৌ ইতিহাসবিদ ও সংবাদিক। তিনি সমুদ্র বিষয়ক ভূ-রাজনীতির প্রবক্তা। তিনি বলেন, “একটি জাতি একটি জায়গায় স্থির থেকে ঠিক থাকতে পারে না। তাকে হয় বিকাশ লাভ করতে হবে, না হয় ধ্বংস হয়ে যেতে হবে।” তার মতে সমুদ্র হচ্ছে শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তাছাড়া নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে সমুদ্রের প্রয়োজন রয়েছে। তার মতানুযায়ী যে জাতি সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে জাতি নিজের দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

৪. হ্যালফোর্ড জে ম্যাকাইন্ডার এর তত্ত্ব: হৃদভূমি তত্ত্বের প্রবক্তা ব্রিটেনের প্রখ্যাত পণ্ডিত হ্যালফোর্ড জে. ম্যাকাইন্ডার জীববিদ্যার ইতিহাস, আইন এবং ভূগোলে বিশেষ পণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের পরিচালক ছিলেন। ১৯০৪ সালে | লন্ডনের জিওগ্রাফিক সোসাইটিতে তিনি "The Grographical Pivot of History' শিরোনামে ভাষণ দেন। তাঁর মতে, ইউরোপীয় ইতিহাস হচ্ছে প্রধানত সম্পূর্ণ স্থলবেষ্টিত ইউরোপীয় ভূখণ্ডের অভ্যন্তরভাগ সম্পর্কিত এবং তা হচ্ছে "কেন্দ্রীয় এলাকা। (Pivot Area) বা হৃদভূমি (Heart land)। ম্যাকাইন্ডার তাঁর হৃদভূমি তত্ত্বকে নিম্নবিধ বাণীর মাধ্যমে প্রকাশ করেন_

1. যে পূর্ব ইউরোপ শাসন করে, সে হৃদভূমি শাসন করে।
ii. যে হৃদভূমি শাসন করে, সে বিশ্বদ্বীপ শাসন করে। iii. যে বিশ্বদ্বীপ শাসন করে, সে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৫. কার্ল হাউজ হফার এর তত্ত্ব : কার্ল হাউস হফ এর ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ক মতামত সবচেয়ে বেশি উন্নত ও যুগোপযোগী। তিনি তার তত্ত্বে বলেন, “সামরিক শক্তি অর্জনের জন্য একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে।” যেসব জাতি, এলাকা, ভাষা অর্থনৈতিকভাবে জার্মান স্বার্থের জন্য উপযোগী সে সব জাতি জার্মান শাসনাধীনে আসবে। পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ - আফ্রো-এশিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে জার্মান জাতি সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে উচ্চ স্থানে অবস্থান করবে। ভূ-রাজনীতি সম্পর্কিত তাঁর ধারণা নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা যায়। 

i. তাঁর মতে, সামরিক শক্তি অর্জনের জন্য একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া দরকার।

ii. যে সমস্ত্র এলাকা, ভাষা এবং জাতি অর্থনৈতিকভাবে জার্মান স্বার্থের জন্য উপযোগী, সে সমস্ত এলাকা জার্মানির শাসনাধীন আসবে।

iii. পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ আফ্রো-এশিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ করে জার্মানি অজেয় অর্থনৈতিক ও সামরিক অবস্থানে পৌঁছে যাবে।

iv. সীমান্ত অস্থায়ী ব্যাপার যা জার্মান স্বার্থে পরিবর্তিত হবে এবং এটি যুদ্ধ শুরু করার জন্য খুবই উপযোগী।

হাউজহফার জোর দিয়ে বলেন যে, যেহেতু জার্মানদের পর্যাপ্ত ভূমি নেই, তাই অন্যের ভূমি দখল করার অধিকার তাদের রয়েছে।

৬. নিকোলাস জে. স্পাইকম্যান এর তত্ত্ব : তিনি ভূ রাজনীতিতে ভৌগোলিক উপাদানের ভিত্তিতে একটি দেশের নিরাপত্তানীতির পরিকল্পনা বলে ব্যাখ্যা করেন। তিনি একটি দেশের অবস্থান ওই দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিশ্বাস করেন। তিনি শক্তিকে শান্তি রক্ষার অন্যতম উপাদান বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, শুধু বৃহৎ শক্তিগুলোর শান্তি সংরক্ষণ বা কার্যকর ধারার ক্ষমতা রয়েছে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সাম্প্রতিককালের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চ হচ্ছে “ভূ-রাজনীতি তত্ত্ব”। কেননা বর্তমানকালের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে যা বুঝায় তা মূলত গড়ে উঠেছে এবং পরিচালিত হচ্ছে ভূ রাজনীতি তত্ত্ব অনুযায়ী। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধ্যয়নের জন্য প্রয়োজন ভূ-রাজনীতি অধ্যয়ন। আর বিংশ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন পণ্ডিতগণ বিভিন্নভাবে ভূ-রাজনীতি সম্পর্কে নানা তত্ত্ব দিয়েছেন, এসব তত্ত্ব অধ্যয়নের মাধ্যমে ভূ-রাজনীতি অধ্যয়ন অত্যন্ত সহজ হবে। কেননা ভূ-রাজনীতি তত্ত্ব গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক চাহিদাকে কেন্দ্র করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url