ভূরাজনীতির গুরুত্ব আলোচনা করো।
ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রই অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক বজায় না রেখে চলতে পারে না। এক্ষেত্রে কোনো দেশ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য অন্য দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। আর অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয় পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির মধ্য দিয়ে। পরাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে "ভূরাজনীতির গুরুত্ব" অপরিসীম। এক্ষেত্রে যে কোনো দেশের ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যে কোনো দেশ লাভ বা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
ভূরাজনীতি শব্দের অর্থ কি? : Geo-Politics শব্দটি জার্মান শব্দ Geopolitik এর ইংরেজি রূপ। যেটি গ্রিক শব্দ 'Geo ' ও Politiko' শব্দ দুট থেকে এসেছে। যার অর্থ ভৌগোলিক বিষয়াবলির ভিত্তিতে যে রাজনীতি ।
ভূ-রাজনীতির গুরুত্ব/পররাষ্ট্রনীতির উপাদান হিসেবে ভূরাজনীতির গুরুত্ব
পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ভূরাজনীতির ভূমিকা অপরিসীম। কতকগুলো বিষয়ের উপর ভূরাজনীতি প্রতিষ্ঠিত। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো :
১. ভৌগোলিক অবস্থান: যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য তার ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের অবস্থান যদি স্থল, জল বেষ্টিত হয় তবে তাদের নিজস্ব সুবিধা এবং অসুবিধা থাকে । যেমন নেপাল Land locked হওয়ার কারণে তা ভারতের উপর নির্ভর করে। নেপালের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি ভারত কেন্দ্রিক।
২. প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা : কোনো বৃহৎ রাষ্ট্রের পাশে যদি কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অবস্থান করে তাহলে বৃহৎ রাষ্ট্র অবশ্যই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করবে। উদাহরণস্বরূপ ভারতের পাশে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই ভারত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে।
৩. আকার ও আয়তন : যে দেশের আকার আয়তন ও জনসংখ্যা বেশি সেসব দেশ পররাষ্ট্রনীতিতে বেশি শক্তিশালী যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রনীতি অনেক বেশি শক্তিশালী। ফলে তারা প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে।
৪. জলবায়ু : বিশ্বের প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে জলবায়ু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে কোনো দেশের উৎপাদনশীলতা ও মানুষের কর্মদক্ষতা তার জলবায়ুর উপর নির্ভর করে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
৫. ভূপ্রকৃতি : ভূপ্রকৃতি ভূরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাষ্ট্রের ভূপ্রকৃতি তার পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। কোনো রাষ্ট্রের সীমান্ত যদি পাহাড় বা নদী বেষ্টিত হয়, তাহলে তা প্রতিবেশী দেশ থেকে অনেক বেশি নিরাপদ থাকে। আর কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যদি পাহাড়, বনভূমি অথবা নদীর ঘনত্ব বেশি থাকে তাহলে দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের অভাবে বোধ হ্রাস পেতে পারে। আর যদি যোগাযোগে কোন বাধা না থাকে তাহলে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় যা পররাষ্ট্রনীতি শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।
৬. অভিন্ন সংস্কৃতি: রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রায় অভিন্ন সংস্কৃতি জাতীয়তাবোধ তৈরিতে কাজ করে। ফলে তা রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। যে কোনো দেশের ভাষা, কালচার, মূল্যবোধ, জীবনধারা সে দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য তৈরিতে ভূমিকা পালন করে। কোনো রাষ্ট্রে যদি আভ্যন্তরীণ কোনো কোন্দল চলতে থাকে, তাহলে তা অন্য দেশের প্রভাবের আওতায় পড়তে পারে।
৭. সরকার পদ্ধতি: যেকোনো রাষ্ট্রের সরকার পদ্ধতি পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। তাই বলা যায় কোনো দেশের সরকার পদ্ধতি বা রাষ্ট্রনীতি ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৮. প্রাকৃতিক সম্পদ : প্রাকৃতিক সম্পদ ভূরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যে দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে যত বেশি উন্নত সমৃদ্ধ সে দেশের পররাষ্ট্রনীতি তত বেশি শক্তিশালী। পররাষ্ট্রনীতির উপর ভিত্তি করে প্রাকৃতিক সম্পদকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- তেল ও খাদ্য। আরব বিশ্বের দেশগুলোর তেল সমৃদ্ধির কারণে তাদের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা বিশ্ব জ্বালানির জন্য মধ্য প্রাচ্যের দেশসমূহের উপর নির্ভরশীল।
৯. প্রতিবেশী: ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র তাদের নীতি, আদর্শ, সংস্কৃতি প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেয়। তাই এভাবে বৃহৎ রাষ্ট্র প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। অনেক সময় প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থান যুদ্ধের অবতারণা করে। তাই বলা যায় যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রকৃতির উপর পররাষ্ট্রনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল।
উপসংহার: উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অবশ্য একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি কতিপয় বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, শুধু একটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল নয়। যে সকল দেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী তারা তাদের অনুকূলে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে পারে এবং অন্য রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আর কোনো কোনো দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক অবস্থান ভূরাজনীতির দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।