অর্থনৈতিক ও সামরিক নীতি নির্ধারণে ভূ-রাজনীতির ভূমিকা

সামরিক ও অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে ভূ-রাজনীতির ভূমিকা আলোচনা করো

ভূরাজনীতির ভূমিকা সামরিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তার উদাহরণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধুমাত্র ভৌগোলিক অবস্থানে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। অপরদিকে, ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জার্মানির সেখানে পতন হয়। যে কোনো দেশের সামরিক নীতি নির্ধারণে ভূরাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব রাখে ।

সামরিক নীতি নির্ধারণে ভূরাজনীতির ভূমিকা

সামরিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির ভূমিকা নিচে আলোচনা করা হলো :

১. প্রতিবেশী নিয়ন্ত্রণ : বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র তার শক্তি ও প্রভাবের মাধ্যমে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করে থাকে। বড় আয়তনের রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে এ কাজ করা সহজ হয়। সকল ছোট রাষ্ট্রগুলো পার্শ্ববর্তী বড় রাষ্ট্রের দ্বারা প্রভাবিত। এজন্য লক্ষ করলে দেখা যাবে ভূরাজনৈতিক কারণে ভুটানের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তার কারণ হলো ভূরাজনীতির মাধ্যমে ভুটানের উপর প্রভাব বিস্তার করা হয়।

২. সামরিক সরঞ্জাম যোগাড় : কোনো কোনো দেশ কোন রাষ্ট্রের দ্বারা কিভাবে আক্রমণের শিকার হতে পারে। সেই চিন্তা মাথায় রেখে সেসব রাষ্ট্র তাদের দেশ বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্ধারণ করে থাকে। সকল দেশ সীমান্তে তাদের নিরাপত্তা জোরদার করে থাকে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে ।

৩. অস্ত্র প্রতিযোগিতা : ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূরাজনীতির গুরুত্বের কারণে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক দ্বন্দ্বের জের ধরে এক দেশ অন্য দেশের চেয়ে শক্তিশালী হওয়ার জন্য অস্ত্র ক্রয় কর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। ভারত, পাকিস্তান প্রায় ৫০ বছর যাবৎ দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্বের কারণে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে প্রতিনিয়ত বিলিয়ন ডলার খরচ করে অস্ত্র আমদানি করছে। কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে সর্বদা অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব বিরাজমান।

৪. জাতীয় নিরাপত্তা নির্ধারণ : ভূরাজনৈতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই একটি দেশের কি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হবে তা নির্ধারণ করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে ভৌগোলিক অবস্থানে অবস্থিত দেশসমূহের নিরাপত্তা কাঠামোও ভিন্ন হয়। যেসব দেশ স্থলবেষ্টিত তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এক রকম আবার যেসব দেশ সমুদ্র বেষ্টিত তাদের নীতি অন্যরকম। আবার যে দেশ স্থল ও জল বেষ্টিত তাদের নিরাপত্তা কেমন হবে ইত্যাদি ভূরাজনীতির পাঠে জানা যায়।

৫. প্রাকৃতিক সুরক্ষা : কিছু দেশের ভৌগোলিক অবস্থান তাকে বাইরের যে কোনো আক্রমণ থেকে সহজেই নিরাপদে রাখে। দুর্গম যাতায়াত ও পাহাড় বেষ্টিত দেশ সহজেই বহিঃশত্রুর আক্রমণের সম্মুখীন হয় না কারণ প্রাকৃতিক সুরক্ষা।

অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে ভূরাজনীতির ভূমিকা

অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক ভূমিকা নিম্নরূপ :

১. উৎপাদনের ক্ষেত্রে : কোন দেশ কি উৎপাদন করবে তা সেই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক অবস্থাই নির্ধারণ করে দেয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জানা যায় যে, একটি রাষ্ট্র তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে কি কি কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারবে বা তার আমদানি রপ্তানি কেমন হবে ভূরাজনীতির জ্ঞান সেক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

২. বাজার সৃষ্টি : যে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সম্পদ যতবেশি সেই রাষ্ট্র তত সমৃদ্ধ। বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের যোগাযোগ ও আদান-প্রদান করার মাধ্যমেই চলতে হয়। কোনো রাষ্ট্রে যে সম্পদের পরিমাণ বেশি তার উপর ভিত্তি করে তাকে বাজার সৃষ্টি করতে হবে সেই পণ্যের জন্য বাজার সৃষ্টি না করতে পারলে সেই সম্পদের কাঁচামাল কোনো কাজে আসবে না। সেই কারণের ঐসব রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে ভূরাজনীতির ভূমিকা থাকে।

৩. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য : ভূরাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। সব রাষ্ট্রই চায় কম ব্যয়ে তার পাশের রাষ্ট্র থেকে আমদানি রপ্তানি করতে। এর ফলে ঐসব রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী অন্য রাষ্ট্র তাদের কাঁচামাল সরবরাহ করে। এক্ষেত্রে ভূরাজনীতি অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।

৪. যোগাযোগের ক্ষেত্রে: যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলে। সেসব রাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থা তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে ভালো তাদের মধ্যে দ্রুত ব্যবসা বাণিজ্য প্রসার লাভ করে। অনেক সময় সড়ক পথের সুন্দর যোগাযোগ পণ্যের আমদানি-রপ্তানির খরচ কমিয়ে দেয়। অপরদিকে, ভৌগোলিকভাবে দূরে অবস্থিত রাষ্ট্রসমূহের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের খরচ বেশি হয়। কিন্তু সমুদ্র তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো আবার জাহাজের মাধ্যমে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে যা ভূরাজনীতির পাঠে জানা যায়।

৫. পণ্যের মান : প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অনেক সময় পণ্যের মান নির্ভর করে। কারণ সব পণ্য একদেশে একমাত্রায় ভালোভাবে উৎপাদন হয় না। ফলে যে দেশের পণ্য ভালো সে দেশ থেকে পণ্য আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশসমূহ তাদের আগ্রহ প্রকাশ করে।

উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে ভূরাজনীতি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। কারণ ভূরাজনীতি অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উৎসের অনুসন্ধান করতে পারি। এর মাধ্যমে কোন কোন পণ্য আমদানি রপ্তানি করলে দেশের অর্থনীতি দ্রুত চাঙ্গা হবে তার সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের পণ্য রপ্তানির করার জন্য বাজার সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির জ্ঞান থাকা আবশ্যক ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url