সেন্ট সাইমনের সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, ধারণা, মূল্যায়ন।
প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে যে সকল প্রশ্নের উত্তর জানবো, চলুন সেগুলো আগে দেখে নেওয়া যাক, 'সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সেন্ট সাইমনের ধারণা ব্যক্ত কর।' 'সাইমনের সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য লিখ ।' 'সাইমনের সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?' 'সেন্ট সাইমনের সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সমুহ আলোচনা কর।'
'সাইমনের সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর।' ' সেন্ট সাইমনের সমাজতন্ত্রের ধারণার মূল্যায়ন কর।' চলুন মূল আলোচনা শুরু করা যাক এবার।
সেন্ট সাইমন ছিলেন একজন ফরাসি সমাজতান্ত্রিক। তিনি সমাজব্যবস্থা পরিচালনার জন্য এক অভিনব ব্যবস্থার অবতারণা করেছেন। তিনি শিল্পপতিদের হাতে সমাজব্যবস্থার ভার অর্পণ করেন। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি এই অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এজন্য তাকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অগ্রপথিক হিসেবে মনে করা হয়।
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সেন্ট সাইমনের ধারণা কী ছিল?
সেন্ট সাইমন নতুন সমাজব্যবস্থা প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি পুরাতন সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় শ্রম বিভাজন ছিল। পরিশ্রম না করেও সকল ক্ষমতা ভোগ দখল করতো একশ্রেণি। সমাজে শ্রমিক শ্রেণিকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। সমাজ শিল্পপতি ও শ্রমিক শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। শ্রমিক শ্রেণি পুঁজিপতি শ্রেণি কর্তৃক নানা বৈষম্যের শিকার হয়। যা ছিল পুরাতন সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য তিনি। সমাজ ব্যবস্থার পরিচালনার ভার শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তবে তিনি তাঁর সমাজতাত্ত্বিক চিন্তায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি উচ্ছেদের কথা বলেননি। তিনি সম্পত্তিতে বঞ্চিত শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শিল্পপতিরাই পারে সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর মতে, সমাজের মূল নির্বাহী হবেন শিল্পপতিরাই। তারা শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। ফলে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির পার্থক্য দূরীভূত হবে এবং বৈষম্যমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল সেন্ট সাইমনের সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। পুরাতন সমাজব্যবস্থার অসংগতি কে উচ্ছেদ করে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এজন্য তিনি সমাজব্যবস্থা পরিচালনার ভার শিল্পপতিদের হাতে ন্যস্ত করেন।
সেন্ট সাইমনের সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
সেন্ট সাইমনকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অগ্রপথিক বলা হয়। তিনি সমাজে নতুন যুগের সূচনার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থায় এক অভিনব রূপ অবতারণা করেছেন। সেন্ট সাইমনের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ পর্যালোচনা করলে তার সমাজ সম্পর্কে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
সাইমনের সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য : নিচে সাইমনের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মালিক-শ্রমিকদের সুসম্পর্ক : সাইমন সমাজতন্ত্রের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে কার্ল মার্কস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতো মালিক-শ্রমিকের কোন দ্বন্দ্বের বিষয় দেখাননি বরং বৈজ্ঞানিক | সমাজতন্ত্রে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নতুন সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে তোলার পক্ষে মত দেন।
২. অর্থনৈতিক স্বার্থের উপর গুরুত্ব প্রদান : সেন্ট সাইমন সমাজতন্ত্রে রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বেশিই বলেছেন। অর্থনীতিতে যদি সাম্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমার প্রভৃতি না থাকে তবে এগুলোর কোন মূল্য নেই। এজন্য তিনি অর্থনীতিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
৩. ধর্মের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান : সেন্ট সাইমন সমাজতন্ত্রকে ধর্মের সাথে সঙ্গতি বিধান করে এগিয়ে নিয়েছেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি ধর্মকে ছোট করে দেখাননি তাঁর সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার সব সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার কথা বলেন তাতে ধর্মের সাথে মিল রেখে নিউ ক্রিশ্চিয়ানিটি নামে এক নতুন নৈতিক মানের কথা সুপারিশ করেন।
৪. অর্থনীতিতে মালিক-শ্রমিকদের প্রাধান্য : মালিক ও শ্রমিকদের প্রাধান্য নতুন সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ ব্যবস্থায় মালিক শ্রমিকদের কোনো বিরোধে যাবে না। সমাজতান্ত্রিক ধারণায় তাদেরকে সবসময় একই শ্রেণিভূক্ত ও স্বার্থভাবাপন্ন বলে মনে করেছেন। অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই মালিক ও শ্রমিক উভয়েরই প্রাধান্য দিয়েছেন।
৫. শিল্পপতিদের হাতে ক্ষমতা : সেন্ট সাইমন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিল্পপতিদের হাতে ক্ষমতা অর্পনের কথা বলেছেন। তিনি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে সমাজের নানা দিক চিন্তা করে একটি শিল্পসমাজ এবং স্বাভাবিকভাবেই এই সমাজে শিল্পী, বিজ্ঞানী ও শিল্পপতিদের ভূমিকাই থাকবে মূখ্য।
৬. ব্যক্তিগত সম্পত্তি বজায় রাখা : সেন্ট সাইমন তাঁর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার কথা বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পুঁজি ও শ্রমের যৌথ উদ্যোগে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সুতরাং মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষই ন্যায্য অধিকার পাওয়ার দাবিদার।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সেন্ট সাইমন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতন্ত্রের এ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাতে তার সমাজতন্ত্রে নানা বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।
সেন্ট সাইমনের সমাজতন্ত্রের ধারণার মূল্যায়ন
সেন্ট সাইমন ছিলেন একজন ফরাসি সমাজতান্ত্রিক। তিনি তাঁর সমাজতন্ত্রের আলোচনায় এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছেন। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল তার সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি শিল্পপতিদের হাতে সমাজের শাসনভার ন্যস্ত করার পক্ষপাতি ছিলেন।
মূল্যায়ন : বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ সেন্ট সাইমনের সমাজতন্ত্রের মূল্যায়ন করেছেন। নিচে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন : পুরাতন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন করে তিনি নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তিনি সচেতনতার সাথে সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর হন। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর সমাজ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ।
উন্নত চিন্তাধারার অধিকারী : সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাইমনের চিন্তা চেতনা ছিল উন্নতমানের। তিনি দর্শন, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হন। এটি তাঁর চিন্তা চেতনার ধারাকে ব্যাখ্যা করে।
মার্কসীয় ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ : তাঁর চিন্তা চেতনা অনেকটা সমালোচিত হলেও মার্কসের সাথে তাঁর চিন্তার অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উভয়ের লক্ষ্য ছিল শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে শ্রমিক ও মালিক শ্রেণিকে একীভূত করা।
সমাজতন্ত্রের পথিকৃত: অনেক দার্শনিক সেন্ট সাইমনের সমাজতন্ত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পথিকৃৎ বলে অভিহিত করেন। তিনি সর্বপ্রথম সমাজের বৈষম্যমূলক ধারণা জনসম্মুখে উপস্থাপন করেন। তিনি সম্পত্তিতে | বঞ্চিত শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
শ্রেণিবৈষম্য দূরীভূত : সেন্ট সাইমন সমাজের যে শ্রেণিবৈষম্য ছিল তা দূরীভূত করেন। সকলের সুযোগ-সুবিধা একই মাপকাঠিতে আবদ্ধ করেন। পুরাতন সমাজের বিশেষ শ্রেণির প্রাধান্য হ্রাস করেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মার্কস সাইমনের মূল লক্ষ্য একই ছিল। মার্কস তাঁর সমাজতন্ত্রের অনেক ধারণা সেন্ট সাইমন থেকে গ্রহণ করেছিলেন। সাইমন সমাজতন্ত্রের যে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন যা তাকে সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে অমর করে রেখেছেন।