কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলতে কী বোঝায়? এর সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের জন্য যে রাষ্ট্র কাজ করে তাকে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বলে। আধুনিককালে উদারনৈতিক গণতন্ত্রই জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের রূপান্তরিত হয়েছে।
রাজনৈতিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক ও পৌর অধিকারসমূহের স্বীকৃতি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার একাধিক রাজনৈতিক দল, নিরপেক্ষ আদালত, ন্যায়বিচার প্রভৃতিতে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
জনকল্যাণকর রাষ্ট্র দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করে। বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে। জনগণের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য চেষ্টা করে ।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সংজ্ঞা
বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :
হার্বার্ট লেম্যান (Harbert Lehman) বলেছেন, “যে রাষ্ট্রে নাগরিকের ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং তাদের প্রতিকার সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় সে রাষ্ট্রকে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বলে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো (Plato) এর মতে, “জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হলো এমন একটি রাষ্ট্র যার উদ্দেশ্য হলো মানুষের মাঝে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।”
জি. ডি. এইচ. কোল ( G. D. H. Cole) এর ভাষায়, "The welfare state is a society in which an assured minimum standard of living and opportunity becomes the possession of every citizens."
জাতিসংঘের ভাষায়, “যে রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুবিধা প্রদান করে এবং বেকারত্ব, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে জীবিকা অর্জনে ব্যর্থ হলে জনগণের পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করে তাকেই জনকল্যাণকর রাষ্ট্র বলে।'
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাসমূহের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হলো এমনই একটি রাষ্ট্র যা ব্যক্তিস্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে জনসেবামূলক কাজের দ্বারা জনকল্যাণ নিশ্চিত করে।
কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কাকে বলে?
ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি এবং মঙ্গলের জন্য যে রাষ্ট্র কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে থাকে তাকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র বলে। আধুনিক রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণের জন্য অপরিহার্য কার্যাবলি ছাড়াও বহুবিধ সমাজকল্যাণমূলক কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। নিম্নে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করা হলো :
কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য
১. বহুমুখী জনহিতকর কার্যাদি সম্পাদন : কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দান এবং শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা ছাড়াও মানবকল্যাণে বহুবিধ জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বিনা খরচে শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রদান, সামাজিক বিমা ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, বেকার ভাতা প্রদান, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পানীয় জলের সরবরাহ এবং সাহায্য ও পুনর্বাসন কাজ করে থাকে।
২. অর্থনৈতিক উন্নতি : কল্যাণমূলক রাষ্ট্র আর্থিক আয়ের উৎসসমূহ সন্ধান করে। এছাড়া সুষম কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করে জনগণের অর্থনৈতিক কল্যাণের পথ প্রশস্ত করে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রপরিকল্পনার ভিত্তিতে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতীয় সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করে।
৩. সর্বজনীন কল্যাণ : এরূপ রাষ্ট্র কোনো শ্রেণিবিশেষের কল্যাণের জন্য কাজ করে না। বরং শ্রেণিস্বর্থের ঊর্ধ্বে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করে থাকে। এর ফলে সর্বজনীন কল্যাণ সাধিত হয়।
৪. কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব মোচন : কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য থাকে পূর্ণ কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব মোচন করা। এজন্য কল্যাণমূলক রাষ্ট্র পরিকল্পনার সাহায্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে সচেষ্ট হয়।
৫. সমাজকল্যাণ ও জনকল্যাণ : কল্যাণমূলক রাষ্ট্র জনকল্যাণের জন্য নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা করে। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, জনসেবাই কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য। সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবন ও সমাজ গঠনের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এরূপ রাষ্ট্র মানব সভ্যতা ও প্রগতির ধারাকে অব্যাহত রেখেছে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন।