সমাজতন্ত্রের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি সমূহ আলোচনা কর।
প্রিয় পাঠক আসসালামু আলাইকুম, আশা করি আপনি ভালো আছেন। আমরা আজকে এই আর্টিকেলের মাধ্যমে যে সকল প্রশ্নের উত্তর জানবো, চলুন সেগুলোর আগে দেখে নেই। সমাজতন্ত্রবাদ কি? সমাজতন্ত্রবাদ কাকে বলে, সমাজতন্ত্রবাদ বলতে কি বোঝায়, সমাজতন্ত্রের গুণাবলি সম্পর্কে লিখ। সমাজতন্ত্রের গুণগুলো উল্লেখ কর। সমাজতন্ত্রের ত্রুটি সমূহ লিখ। সমাজতন্ত্রের ত্রুটি গুলো কি কি? সমাজতন্ত্রের ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা কর। সমাজতন্ত্রের ত্রুটি গুলো সংক্ষেপে লিখ। এখানে আমরা আরো জানবো, সমাজতন্ত্রের দোষ ও গুণ আলোচনা কর। সমাজতন্ত্রবাদের পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি সমূহ। সমাজতন্ত্রের সুবিধা এবং অসুবিধা আলোচনা কর। এবং সমাজতন্ত্রের সমালোচনা কর। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, সমাজতন্ত্রের দোষ গুণ, সুবিধা অসুবিধা, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি সবগুলো একই ধরনের প্রশ্ন।
সমাজতন্ত্রবাদ কি?
সমাজতন্ত্রের মূলকথা হ'ল, উৎপাদন ও বন্টনের উপকরণগুলো ব্যক্তি মালিকানা হতে ক্রমান্বয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ মতবাদ অনুসারে পুঁজির বাস্তব প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিন্তু ব্যক্তি পুঁজিপতির প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রীগণ মানবসমাজকে একটি রাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে সংগঠিত করবে। এই রাজনৈতিক সংস্থাই হবে ভূমি, পুঁজি ও উৎপাদন উপকরণের মালিক ও ব্যবস্থাপক। এই সংস্থা জীবনের সর্বক্ষেত্রে তার নিয়ন্ত্রণের আওতা বিস্তৃত করবে যাতে সাম্য ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। দ্রব্য উৎপাদনে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না। পুঁজি ব্যবহৃত হবে সকলের কল্যাণ উদ্দেশ্যে, এখানে মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থ বিবেচনা করা হবে না। রাষ্ট্র যেহেতু সাধারণের কল্যাণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করবে তাই সবকিছুরই নিয়ন্ত্রক হবে রাষ্ট্র। সমাজতন্ত্রে সরকারের কার্যাবলী এবং তার সীমানা বৃদ্ধির কথা বলা হয়। এর উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের গুরুত্ব বৃদ্ধি নয়। বরং সমাজতন্ত্রের ধারণা মতে এ ভাবেই ব্যক্তির ন্যায় ও স্বাধীনতার চাহিদা মেটান সম্ভব।
সমাজতন্ত্রের পক্ষে এবং বিপক্ষের যুক্তি সমূহ
সমাজতন্ত্রের গুণাবলি/পক্ষে যুক্তি : কোন শাসনব্যবস্থায় খারাপ দিক যেমন থাকে তেমনি ভালো দিকও থাকে। সমাজতন্ত্র শাসন প্রক্রিয়াটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজের সার্বিক কল্যাণের নিমিত্ত প্রণয়ন করা হয়েছে। নিচে সমাজতন্ত্রবাদের গুণাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. জনগণের কল্যাণ: সমাজতন্ত্রে জনগণের সার্বিক কল্যাণসাধনের ব্যবস্থা রয়েছে। এতে সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে একনায়কত্বের কথা বলা হলেও এর মূল কথা হলো সার্বিক জনকল্যাণ সাধন। রাষ্ট্রই সকল শ্রেণির মানুষের অভিভাবক ও কল্যাণে নিয়োজিত ।
২. সম্পদের সুষম বণ্টন: সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের সম্পদের সুষম বণ্টন লক্ষ্য করা যায়। এ শাসনব্যবস্থায় পুঁজিবাদের কোন ব্যবস্থা না থাকায় সম্পদের সুষম বণ্টন করা সহজ হয়। সকল উৎপাদন ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ: এ শাসনব্যবস্থায় জনগণের সকল মৌলিক চাহিদা ও অধিকার পূরণ করার চেষ্টা করে। অন্যান্য শাসনব্যবস্থা থেকে এ ব্যবস্থায় জনগণ মৌলিক চাহিদা বেশি পূরণ করতে সক্ষম হয়।
৪. শোষণ মুক্ত সমাজ: সমাজতন্ত্রে শোষণ, বঞ্চনা প্রতিরোধের জন্য তৎপর। শ্রেণি শোষণের জন্য সমাজতন্ত্র সর্বনা সংগ্রাম করে আসছে। এ শাসনব্যবস্থায় শ্রমিক নির্যাতন ও অন্যান্য বিষয়গুলো সহ্য করে না।
৫. শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ: এ শাসনব্যবস্থায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো শিক্ষাব্যবস্থায় সম্প্রসারণ। এ ব্যবস্থায় সকল প্রকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ কার্য পরিচালনা করা হয় ফলে শিক্ষা সম্প্রসারিত হয়।
৬. নারীর মুক্তি সাধন : এ শাসনব্যবস্থায় নারীরা অন্যান্য শাসনব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতা পায়। এখানে নারী পুরুষ পার্থক্য করে দেখা হয় না। এজন্য ব্যাপকভাবে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
৭. অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন : সমাজতন্ত্রে অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা হয়। মূলত বিশৃঙ্খলা অর্থনীতির হাত থেকে সমাজের মানুষকে রক্ষার্থে এ ব্যবস্থায় কার্য সম্পাদিত হয়। যাতে অর্থনীতি নতুন করে মানুষের কল্যাণে নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
সমাজতন্ত্রের দোষ/বিপক্ষে যুক্তিসমূহ: সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে ত্রুটি হচ্ছে এ শাসনব্যবস্থায় বেশি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দেখানো হয়। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন সবকিছুই রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। এজন্য এ শাসনব্যবস্থায় মানুষ নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে না ফলে বিতৃষ্ণা চলে আসে। নিচে সমাজতন্ত্রের ত্রুটিসমূহ আলোচিত হলো :
১. ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ: সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে পারে না। কোন কিছুতে রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হয় ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না।
২. অসংগতিপূর্ণ শাসনব্যবস্থা: সমাজতন্ত্রে বাস্তবতার সাথে কোন সামঞ্জস্য থাকে না। এ শাসনব্যবস্থায় সমাজের মানুষকে বুর্জোয়া ও সর্বহারা শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে অসংগতিপূর্ণ ।
৩. কর্মস্পৃহা হ্রাস: এ শাসনব্যবস্থায় মানুষ তার পছন্দ মতো উৎপাদন ও মুনাফা উপার্জন করতে পারে না। ফলে মানুষের কর্ম সম্পাদনের যে স্পৃহা থাকে তা দিন দিন হ্রাস পায়।
৪. রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব: সমাজতন্ত্রে অন্যতম ত্রুটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবনের সকল পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দেখানো হয়। এসবের জন্য সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের স্পৃহা কমে যায়।
৫. মানুষ যন্ত্র তুল্য: সমাজতন্ত্রে বড় সমালোচনা হচ্ছে মানুষকে যুক্তির কথা বলেও মানবীয় দৃষ্টিতে না দেখে বরং উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। কার্ল মার্কস ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রেও মানুষের উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
৬. আমলাতন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা: সমাজতন্ত্রে আমলাতন্ত্রের একটি নিষ্ক্রিয় সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র ক্রিয়াশীল থাকলেও সমাজতন্ত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে।
৬. আমলাতন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা: সমাজতন্ত্রে আমলাতন্ত্রের একটি নিষ্ক্রিয় সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র ক্রিয়াশীল থাকলেও সমাজতন্ত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে।
৭. অসংগতিপূর্ণ শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব: কার্ল মার্কস সমাজে যে শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেছেন আসলে তা অসংগতিপূর্ণ। সমাজে আদি শাসনব্যবস্থা থেকে যে শ্রেণিসংগ্রাম চলে আসছে তা নয়। সবসময় সমাজে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করতো একথা সঙ্গত নয়।
৮. মনস্তত্ত্ব বিরোধী: সমাজতন্ত্রে মানুষের মনের উপর জোর খাটানো হয়। মানুষ যেটা করতে চায় না জোর করে করে সেটা চাপিয়ে দেয়া হয়। ফলে মানব মনের সুপ্ত বাসনাগুলো প্রস্ফুটিত হতে পারে না। এজন্য সমাজতন্ত্র মনস্তত্ত্ব বিরোধী শাসনব্যবস্থা।
উপসংহার: উপযুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রত্যেক শাসনব্যবস্থায় দোষ-গুণ পরিলক্ষিত হয় সে হিসেবে সমাজতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রেও সুবিধা অসুবিধা সব কিছুই রয়েছে। তবে এ শাসনব্যবস্থা মানবকল্যাণে কাজ করে।