রবার্ট ওয়েনের কে ছিলেন? রবার্ট ওয়েনের কাল্পনিক সমাজতন্ত্র সমালোচনাসহ আলোচনা কর।
প্রিয় পাঠক, আশা করি ভালো আছেন। আজকে আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে যে প্রশ্নের উত্তর জানবো চলুন সেটি আগে জেনে নেওয়া যাক, রবার্ট ওয়েন কে ছিলেন? রবার্ট ওয়েনের পরিচয়। এছাড়াও আর আমরা জানবো, রবার্ট ওয়েনের কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র কি? সমালোচনাসহ রবার্ট ওয়েনের সমাজতান্ত্রিক ধারণা ব্যাখ্যা। রবার্ট ওয়েনের সমাজতান্ত্রিক দর্শনের সমালোচনা।
রবার্ট ওয়েনের কে ছিলেন?
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে সর্বাধিক স্মরণীয় রবার্ট ওয়েন ১৭৭১ সালে ওয়েলসের নিউটাউন নামক স্থানে ইংরেজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। রবার্ট ওয়েন একাধারে শিক্ষাবিদ, সমাজতন্ত্রবাদ, সংস্কারক, ধর্মনিরপেক্ষতা, অনুপ্রেরণাদানকারী ছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে পড়ালেখা সম্ভব হয়নি। পিতা ছিলেন দরিদ্র জিন নির্মাতা। তাঁর পুরো জীবনটাই ছিল কর্মে ভরপুর। শিশু বয়স থেকে শুরু করেন খণ্ড খণ্ড কাজ। মাত্র ১১ বছর বয়সে একটি বস্ত্র কারখানার শ্রমিক হিসেবে নিয়েজিত হন। পরে ম্যানচেস্টার শহরে বস্ত্র তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে নিজেই স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই সফল ব্যবসায়ী হয়ে যান।
পরে তিনি কোম্পানি গঠন করেন এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে নিয়োগ দেন। ১৭৯৯ খ্রি. দিকে স্কটল্যান্ডে বস্ত্র কারখানার গ্রাম নিউ ল্যানার্ক নাম স্থান ক্রয় করে এ গ্রামের প্রায় আড়াই হাজার অধিবাসীর দারিদ্র্যমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ১৮২৪ সালের দিকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানকার ইন্ডিয়ানা রাজ্যের প্রায় ৩০ হাজার ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করে জনপদ গড়ে তোলেন। কিন্তু কালক্রমে রবার্ট ওয়েনের হারমোনি জনপদে জটিলতা বাড়ে ফলে বাতিল হয়ে যায়। রবার্ট ওয়েন তার সামগ্রিক জীবনে মানুষের জন্য অনেক অবদান রেখেছেন।
রবার্ট ওয়েনের কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র
কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে রবার্ট ওয়েন বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ। ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তা হিসেবে রবার্ট ওয়েন স্মরণীয় হয়ে আছেন। তবুও তাঁর সমাজতন্ত্র সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি। রবার্ট ওয়েনের জীবনের প্রভাব পড়ে তাঁর সমাজতন্ত্রের ধারণার উপর। তাঁর পারিবারিক দরিদ্রের কারণেই সমাজের নানা অসংগতি তিনি উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি এক বড় ব্যবসায়ী হয়েও মুনাফাখোরী না হয়ে কিভাবে সমাজকে প্রগতির দিকে বা দরিদ্র মানুষের কল্যাণসাধন করা যায় সেদিকে বেশি নজরদারি করতেন।
তিনি দার্শনিক জেরেমি বেন্থামের উদারনীবাদী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বেহামের “সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক সুখলাভ” করেছেন এই তত্ত্ব দ্বারা সারাজীবন তাড়িত হয়েছেন। এজন্য যখন তার দুর্দিন গেছে তখনো তিনি বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের ছাটাই করেননি। তিনি ধারণা করতেন কোন ব্যবসায় বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উচিত তার ব্যয় নির্বাহের জন্য শতকরা পাঁচ ভাগ বাকি রেখে সব মুনাফা শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া।
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাস মানুষ নিজে তার চরিত্র গঠন করতে পারে না। যে পারিপার্শ্বিকতায় মানুষ জন্মগ্রহণ করে বসবাস করে, জীবিকার জন্য করে তার প্রভাব সেই ব্যক্তির চরিত্রে পড়ে। "Essay on the Former Character" গ্রন্থে রবার্ট ওয়েন তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন এভাবে- রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য হলো সামাজিক সংগঠনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা, মানুষের সত্যিকার জীবন লাভের পরিবেশ সৃষ্টি করা। তিনি বলেন শিক্ষার মাধ্যমে যে কোন ব্যক্তি পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। সব সমাজতন্ত্র বলেছে "ব্যক্তি চরিত্রের প্রভাব সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের ফলস্বরূপ।
রবার্ট ওয়েনের সমাজতন্ত্রের সমালোচনা
আপসকামী মনোভাব: তিনি সকলক্ষেত্রে আপসের পন্থা অবলম্বন করেন। যা তার সমাজতান্ত্রিক চেতনায় ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। তিনি শ্রমিক শোষণের রাস্তা তৈরি করে দেন যাতে মালিক-শ্রমিকের সংঘাত নিরসন হয়।
সমাজতন্ত্রের ধারণা থেকে বিচ্যুত: তিনি সমাজ গঠনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে তিনি সমাজতান্ত্রিক মতবাদ থেকে দূরে সরে যান। তাঁর ধারণা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সমাজ কল্যাণই ছিল তার মূল লক্ষ্য। নিজের শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এরূপ ধারণা পোষণ করেন।
আবেগ দ্বারা পরিচালিত : আবেগের উপর ভিত্তি করে তিনি তাঁর সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার কোন ভিত্তি প্রণীত হয়নি। নিজের প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিসাধন হওয়া সত্ত্বেও তিনি শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করেছেন। বাস্তব পদক্ষেপ থেকে দূরে থাকার কারণে তাকে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী বলে অভিহিত করা হয়।
অবৈজ্ঞানিক : তাঁর সমাজতন্ত্র বিজ্ঞানভিত্তিক ছিল না। ফলে সমাজে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান ছিল। এজন্য তাঁর ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।
অর্থনৈতিক চিন্তা প্রসূত নয় : রবার্ট ওয়েনের সমাজতান্ত্রিক চেতনায় অর্থনৈতিক বিষয় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তিনি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোন সুস্পষ্ট ধারণা দেননি। তিনি অর্থনৈতিক উন্নতির পরিবর্তে শ্রমিকের পারিশ্রমিকের দিকে বেশি নজর দিয়েছিলেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, অন্যান্য রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের ন্যায় রবার্ট ওয়েনের সমাজতন্ত্র সমালোচনার স্বীকার হলেও সমাজতন্ত্রের ইতিহাসে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা না ভেবে শ্রমিকের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করেন। যা সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যক ।