সমাজতন্ত্র কাকে বলে? সংজ্ঞা এবং এর বৈশিষ্ট্যসমুহ।

প্রিয় পাঠক আজকে আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জানবো, সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা, সমাজতন্ত্র কী? সমাজতন্ত্র কাকে বলে? সমাজতন্ত্রবাদ বলতে কি বুঝ? সমাজতন্ত্র বলতে কী বুঝ ? সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী? সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সমুহ কি? চলুন তাহলে শুরু করি।

ভূমিকা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমাজতন্ত্রের ধারণা প্রদান করলেও সঠিকভাবে কোন সংজ্ঞা প্রদান করেননি। তবে পরবর্তীকালে কতিপয় দার্শনিক ও প্রতিষ্ঠান সমাজতান্ত্রিক দার্শনিকদের প্রদত্ত ধারণা পর্যালোচনা করে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা নিরূপণ করার চেষ্টা করেছে। অর্থনৈতিক সূত্রের উপর ভিত্তি করে সমাজতন্ত্র একটি নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।

সমাজতন্ত্র কাকে বলে?

যে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণগুলো সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমবায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তাকে সমাজতন্ত্র বলে। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র এমন একটি অর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে সম্পদ ও অর্থের মালিকানা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। অর্থাৎ এখানে ব্যক্তি মালিকানার কোন ভিত্তি নেই। সমাজতন্ত্র হলো সাম্যবাদী সমাজের প্রাথমিক পর্যায়। সমাজতন্ত্র হলো এমন একটি গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা প্রচার করে।

সমাজতন্ত্রের প্রামণ্য সংজ্ঞা

অধ্যাপক হিউবার্ড ব্লান্ট বলেন, “অভিন্ন মালিকানার উৎপাদনের মাধ্যমসমূহকে বিনিময় ও সকলের নিয়েজিত করাই সমাজতন্ত্র"।

সমাজবিজ্ঞানী জন জে. ম্যাসিওনিমের মতে, Socialism is an economic system in which natural resources and the means of producing goods and services are collectively owned."

Encyclopedia তে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, "সাম্যবাদী ব্যবস্থার লক্ষ্যে বর্তমান ব্যবস্থার তুলনায় অধিকতর সুষ্ঠু উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ জনগণের যথাযথ আনুগত্যের উপর ভিত্তিশীল যে নীতি অবলম্বন করে তাই সমাজতন্ত্র।"

মনীষী স্পেনার বলেন, "Socialism is a democratic economic organization which gives the maximum possible of justice and liberty."

পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজতন্ত্র হলো এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রীয় কল্যাণ বয়ে আনে।

উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সম্পদের যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠা করাই হলো সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই মার্কস সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের অবদান অপরিসীম।

সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ

অন্যান্য শাসনব্যবস্থার মতো সমাজতন্ত্রেরও বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য বেরিয়ে আসে। নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. একটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব : সমাজতন্ত্র এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলই বিরাজমান থাকে। এখানে সামাজিক শ্রেণি না থাকায় কৃষক, শ্রমিকরা অন্যান্য পেশাজীবীরা সকলে একটিমাত্র শ্রেণিহীন সমাজের অধীনে থাকে। এজন্য একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে।

২. শ্রেণিহীন সমাজ : এ শাসনব্যবস্থায় কোন শ্রেণির অস্তি ত্ব থাকে না। সমাজে শ্রেণিহীনতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ সমাজতান্ত্রিকদের মতে, সমাজ থেকে শোষণ, বঞ্চনা দূর করতে শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। তাই বলা হয় সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকল মানুষ সমান।

৩. অর্থনৈতিক সাম্য : সমাজতন্ত্র এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে অর্থনৈতিক সাম্য ও স্বাধীনতা রক্ষার সুযোগ রয়েছে। এ ব্যবস্থায় জনগণ পুঁজিবাদী শোষণের মতো শোষিত না হয়ে বরং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সাম্য লাভ করে। সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকল মানুষ সমান। কারো প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হয় না।

৪. সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত : সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য সর্বহারা শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। উৎপাদনের হাতিয়ার ও মালিকানা থাকে সর্বহারা শ্রেণির হাতে। এ শাসনব্যবস্থায় সর্বহারার কর্তৃত্ব স্থাপন করে।

৫. একটিমাত্র রাজনৈতিক দল : সমাজতন্ত্রে একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য দেখা যায়। সমাজতন্ত্রে দেখা যায় কমিউনিস্ট পার্টিরই প্রাধান্য। এখানে কৃষক শ্রমিক সকল শ্রেণি এ দলের সদস্যপদ লাভ করে থাকে সুতরাং বোঝাই যায় যে, এ দলটিতে সমাজের সকল শ্রেণি লোকের প্রাধান্য রয়েছে।

৬. শোষণহীন সমাজব্যবস্থা : সমাজতন্ত্র শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিকগণ মনে করেন যে, সমাজের শোষণ রক্ষা দূর না করলে অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে না। সুতরাং সমাজতন্ত্রে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য।

৭. ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি : সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব থাকে না। এ শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র সকল সম্পত্তির মালিক। এ ব্যবস্থায় জনগণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পত্তি রাখতে পারবেনা যোগ্যতা অনুযায়ী সম্পদ থাকবে।

৮. সাম্যবাদী শাসনব্যবস্থা : সমাজতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে সাম্যবাদ। সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার গড়ে তোলার জন্য সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। মূলত শোষণ থেকে জনসাধারণের রক্ষার্থে সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

৯. রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের প্রাধান্য : সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সবকিছুতেই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সমাজতন্ত্রে জনগণকে রাষ্ট্রের দাস হিসেবে পরিচালিত করতে চেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রের কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে না।

১০. সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরোধী সমাজতন্ত্রে: সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিপরীতে কাজ করে। কারণ সমাজান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাম্রাজ্যবাদের নিয়মকানুন সবসময় বাঁধা দেয়। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমাজতন্ত্রকে নানাভাবে প্রতিহত করে।

১১. সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষা : সমাজতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থ নিয়েই কাজ করে। এ শাসনব্যবস্থায় কোন বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেয়া হয় না।

১২. নির্বাচন ব্যবস্থা : সমাজতন্ত্র এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে নির্বাচন ব্যবস্থার অস্তিত্ব রয়েছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নেতা নির্বাচিত হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজতন্ত্র অন্যান্য শাসনব্যবস্থার মতোই স্বতন্ত্র একটি শাসনব্যবস্থা। সুতরাং স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্যও লক্ষিত হয়। এ ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা হটিয়ে ব্যক্তির প্রয়োজনুযায়ী ভোগ করার সুযোগ পেয়ে থাকে। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সম্পদ ও উৎপাদনের উপকরণ যাবতীয় সেবাসমূহ একটি যৌথ মালিকানার থাকবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url