বাংলাদেশের ভূ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি

পাহাড় পর্বতে ঘেরা কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী। ফলে এ দেশের উর্বর মাটি পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ অঞ্চল। যার বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের বয়ে আনা পলিমাটিতে। এখানকার আবহাওয়া মৃদু ও নাতিশীতোষ্ণ। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং এদেশের বায়ুমণ্ডলও জলীয় বাষ্প পূর্ণ হয়ে থাকে। এককথায়, বাংলাদেশ প্রকৃতির অকৃত্রিম মমতায় গড়া সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত অতুলনীয় একটি দেশ। যার মূলে রয়েছে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির প্রকারভেদ

উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্বের পাহাড়ি অংশ ব্যতীত প্রায় সমগ্র দেশই নদ-নদীর পলল দ্বারা গঠিত হয়েছে। এসব ভূমির অবস্থা ও গঠন এবং ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

১. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ;

২. প্রায়োস্টোসিন যুগের পাহাড়সমূহ ও

৩. সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি।


১. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ 

রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পাহাড়ি এলাকা নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। এই পাহাড়গুলো আসামের লুসাই ও মায়নমারের আরাকান পাহাড়ের সমগোত্রীও বলে মনে করা হয়। এগুলো প্রস্তর, স্লেট জাতীয় প্রস্তর ও কর্দমের সংমিশ্রণ দ্বারা গঠিত। বাংলাদেশের এই টারশিয়ারি পাহাড়গুলোকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা: 

ক. দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড় এবং

খ. উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়।

ক. দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়: রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান জেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার অংশবিশেষে অবস্থিত পাহাড়গুলো নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। এ পাহাড়সমূহ বিশাল পাললিক সমভূমি সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বৈচিত্র্যময় ও অপরূপ করে তুলেছে। পাহাড়ের মাঝে ব উপত্যকা আর এ উপত্যকা দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। এগুলো হলো কর্ণফুলি, সাংগু, মাতামুহুরী, হালদা ও কাসালং। এসব নদী বেশ খরস্রোতা। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ৬২৪ মিটার। বান্দরবান জেলায় অবস্থিত তাজিংডং (বিজয়) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত চূড়া এবং এর উচ্চতা প্রায় ১,২৩৫ মিটার। আর ক্রেওক্রাডং এর উচ্চতা ১,২৩০ মিটার।

খ. উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়সমূহ : সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ছোট-বড় বিচ্ছিন্ন পাহাড়গুলো নিয়ে এ অঞ্চল গঠিত। সিলেট জেলার পাহাড়ি অঞ্চল সিলেট শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে ১৮৬ বর্গ কি.মি. এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এ পার্বত্য ভূমির উচ্চতা ৬০ থেকে ৯০ মিটার। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক শহরে প্রায় ৪০ বর্গ কি.মি স্থানব্যাপী একটি টিলা অবস্থিত, যা ছাতক পাহাড় নামে পরিচিত। এ পার্বত্য ভূমির গড় উচ্চতা ৪০ থেকে ৬০ মিটার। সিলেটের প্রধান পাহাড়গুলো হলো খাসিয়া, ডায়নিত, সুসার চিমপাত্রাঞ্চল, লুসাই ও ত্রিপুরা। এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো হচ্ছে। সুরমা, কুশিয়ারা, মনু ও খোয়াই ।

প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ 

বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাংশের বিশাল বরেন্দ্রভূমি, মধ্যভাগের মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং কুমিল্লা জেলার লালমাই, ময়নামতি পাহাড় এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলের সোপানসমূহ তিন ভাগে বিভক্ত। যথা :

ক. বরেন্দ্রভূমি : নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই বরেন্দ্রভূমি গঠিত। বরেন্দ্র ভূমির আয়তন ৮,২৮৮ বর্গ কি. মি.। এ এলাকার ভূমি অসমতল এবং মাটি লাল ও কাঁকরময়। এ অঞ্চলের নদীগুলো হলো তিস্তা, আত্রাই, ও পুনর্ভবা। ঐতিহাসিক স্থান মহাস্থানগড় এ অঞ্চলে অবস্থিত।

খ. মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়: উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত এ অঞ্চল বিস্তৃত। এটি প্রায়োস্টোসিন যুগের উঁচু ভূমি। এর মোট আয়তন ৪,১০৫ বর্গ কিলোমিটার। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত মধুপুর এবং গাজীপুর জেলায় অবস্থিত ভাওয়ালের গড়। এখানকার মাটির রং লাল এবং কাঁকরময় বলে কৃষিকাজের উপযোগী নয়। এ অঞ্চলের প্রধান নদী ধলেশ্বরী।

গ. লালমাই পাহাড় : কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত লালমাই পাহাড়। এর আয়তন প্রায় ৩৪ বর্গ কি.মি. (১৩ বর্গমাইল)। ময়নামতি পাহাড় এ অঞ্চলে অবস্থিত।

সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি

এ অঞ্চল পদ্মা, যমুনা, মেঘনা প্রভৃতি নদ-নদী এবং এদের উপনদী ও শাখানদী বাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত। বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থান এই অঞ্চলের অন্তর্গত। এই সমভূমির গড় উচ্চতা প্রায় ৯ মিটার (৩০ ফুট)। এ অঞ্চলে অসংখ্য জলাভূমি ও বিল ছড়িয়ে রয়েছে। এগুলো এদেশের ভূপ্রকৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ জলাভূমিতে বর্ষাকালে পানি থাকে। কিন্তু শীত ও গ্রীষ্মের প্রথম দিকে এদের অধিকাংশ শুকিয়ে যায়। সুন্দরবন (আয়তন ৫,৬৬০ বর্গ কি. মি.) ও চলনবিল এই অঞ্চলে অবস্থিত। এছাড়া হাকালুকি হাওড় (মৌলভীবাজার), বিল ডাকাতিয়া (খুলনা), লালপুর (নাটোর) লালখান (শ্রীমঙ্গল) এই অঞ্চলের অন্তর্গত। এই অঞ্চলের মোট আয়তন ১,২৪,৬৬৬ বর্গ কিলোমিটার।

সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো

তিস্তা পলল পাখা: হিমায়লয় পর্বতমালার পাদদেশে নদী বিধোত হয়ে তেঁতুলিয়া দিনাজপুর অঞ্চলে সঞ্চিত পলল সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৯৭-৩৪ মিটার পর্যন্ত উঁচু। এ অঞ্চলের ঢাল প্রতি কিলোমিটার ০.৯১ মিটার। পুরো অঞ্চলটি ঢেউ খেলানো উঁচু নিচু। তিস্তা পল পাখা পূর্বে তিস্তার পশ্চিমে মহানন্দা নদী হতে বগুড়ার শেরপুর পর্যন্ত তিস্তার পুরানো গতিপথ ধরে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত।

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা সমভূমি: এ ভূমিরূপের বৃহত্তম অংশ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা সমভূমির অন্তর্গত। তিস্তা পল পাখা থেকে শুরু করে পদ্মা নদীর উত্তর তাঁর এবং মেঘনা নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত এ সমভূমি বিস্তৃত।

হাওড় অঞ্চল: হাওড় অঞ্চল মূলতঃ সিলেটের উত্তর পূর্বাংশের পাহাড়ি অঞ্চল ব্যতীত পুরো এলাকা জুড়ে বিস্তৃত নিম্নভূমি, প্রধানতঃ সিলেট এই অঞ্চলের আয়তন প্রায় ৪৫০৫.২০ বর্গ কি. মি.। 

মৃতপ্রায় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ: বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম মৃতপ্রায় গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলটি সম্ভবতঃ পুরাতন ব্রক্ষ্মপুত্র ও পদ্মা নদীর মিলিত পল সীমানা থেকে মধুমতি দক্ষিণ সঞ্চয়নের ফলে সৃষ্ট একাধিক বদ্বীপের সমন্বয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত থেকে পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকার নদী গুলো শুকিয়ে গেছে।

সক্ৰিয় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ: সক্রিয় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলটি মধুমতি নদী থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মানদীর দক্ষিণ পাড় থেকে উপকূলীয় সমভূমির সীমান পর্যন্ত বিস্তৃত।

ত্রিপুরা সমভূমি: নোয়াখালী এলাকার কদম পলি সমৃদ্ধ সমভূমিকে ত্রিপুরা সমভূমি বলা হয়। এ অঞ্চলের নদীগুলো চতুঃকোন ভূমিরূপের জন্ম দেয়। প্লাবন ভূমি কিংম্বা বদ্বীপ অঞ্চলের মৃত্তিকা অপেক্ষ এখানকার মাটি লালচে। সমভূমি অঞ্চলকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ পূর্বের পাদদেশীয় ভূমি ও লালমাই পাহাড়, নিম্ন প্লাবন ভূমি এবং উচ্চ প্লাবন ভূমি। ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশে লম্বা জালির ন্যায় পাদদেশীয় সমভূমি ২ থেকে ১৫ কি. মি. প্রশস্ত হয়ে ভারতে বিস্তৃত।

উপকূলীয় সমভূমি: পটুয়াখালী বরিশাল এবং চাঁদপুরের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে উপকূলীয় সমভূমি গঠিত। দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকার সমান্তরালে সমভূমি অতি স্বল্প প্রশস্ত।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সুজলা সুফলা, শস্য শ্যামলা কৃষিপ্রধান এই দেশ বিশ্বে পরিচিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এর ভূপ্রকৃতি। এদেশের ভূপ্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই প্রচুর কৃষিপণ্য, অর্থকরী ফসল ও প্রাকৃতিক সম্পদের সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। এর সমভূমি চাষাবাদের জন্য খুবই উপযোগী ও উর্বর। তাছাড়া আবহাওয়ার জন্যও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। সুন্দরবন দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম। তাই বলা যায় যে, বাংলাদেশের এই সুন্দর ভূপ্রকৃতি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url