বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর।

কূটনীতির একটি বাস্তব দিক নির্দেশনা হলো ভূরাজনীতি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো রাষ্ট্রের অবস্থা ও কৌশল নির্ধারণে ভূরাজনীতি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাপানিদের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে এর উদ্ভব হয় এবং ক্রমেই তা বিশ্ব রাজনীতির অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে উঠে। ভৌগোলিক অবস্থানগত বিশেষ কারণে তা যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। 

অনেক সময় ভূরাজনীতির সুবিধা নেওয়ার জন্য কোনো রাষ্ট্র তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সাথে অঞ্চলভিত্তিক ঐক্য ও মৈত্রী জোট গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের কাছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ময়ানমার ও চীনের কাছে আমাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের গুরুত্ব অনেক।

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক প্রভাবসমূহ 

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিদ্যমান। নিচে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব গুলো আলোচনা করা হলো:

১. ভূরাজনীতি ও ইতিহাস ঐতিহ্য : ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মানুষের গায়ের রং, পোশাক খাদ্যাভ্যাস সবকিছু সাথে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের মিল রয়েছে যা ভূরাজনীতির জন্য খুবই দরকারী। রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য এটি পূর্বশর্ত।

২. পানি বণ্টন সমস্যা: ভাটির দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে প্রবেশকৃত নদীগুলো উজানের নেপাল থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহমান। ভারত শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ দেওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে নিজ স্বার্থে পানি প্রত্যাহার করে নেয় ফারাক্কা বাঁধের ফলে পদ্মা নদীর পানিতে প্রবাহে স্থাবিরতা চলে আসছে।


৩.বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের দেশ হিসেবে: বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে মৎস্য সম্পদ ও খনিজ সম্পদ আহরণ করতে পারে। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের দেশ হিসেবে অনেক সুবিধা পেয়ে থাকে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়া প্রাধান্য বিস্তারের জন্য বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী।

৪. বাংলাদেশ ভারতের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা : বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতের সীমান্ত থাকায় ভূ-কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ ভারতের উপর নির্ভরশীল। আবার ভারতও অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল। ফলে দুই দেশ আন্তঃবিনিময়ের মাধ্যমে কাজ করতে পারবে। দুই দেশই বেশ কিছু সুবিধা পেতে পারে।

৫. সীমানা নির্ধারণ: ছিটমহল নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যার অবসান হয়েছে ২০১৫ সালের ৬-৭ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভিতরের ৫১ ছিটমহল পায় ভারত এবং ভারতের ভিতরের ১১১টি ছিটমহল পায় বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশের আয়তন বৃদ্ধি পায়।

৬. টান্স এশিয়ান রেলওয়ে ও এশিয়ান হাইওয়ে : বাংলাদেশের সাথে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যোগাযোগ ক্ষেত্রে দুটি সুদূরপ্রসারী বৈপ্লবিক সম্ভাবনাময় উদ্যোগ হলো এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে। ১১টি হাইওয়ে জালের মতো সম এশিয়ার সব অঞ্চলকে সংযুক্ত করবে। এই দুই রোড বাংলাদেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে।

৭. বাংলাদেশের সমুদ্রের তেল ও গ্যাসের উপর ভারত ও মিয়ানমারের লোলুপ দৃষ্টি : বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশকে বোকা বানিয়ে রেখে অশুভ আঁতাত গড়ে তোলে ভারত ও মিয়ানমার। এজন্য বাংলাদেশ সরকার যত দ্রুত সম্ভব হয় বঙ্গোপসাগরে নতুন উদ্যোমে অনুসন্ধান চালানো দরকার কারণ আমাদের দক্ষিণাংশে বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাসের নতুন উৎসের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

উপসংহার : দুই ধরনেই ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই রয়েছে। যার কক্সবাজারের গভীরে সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণের কাজ এতদিন ঝুলে ছিল যদিও এটি অবশেষে আলোর মুখ দেখছে। আমাদের দেশ ভূরাজনৈতিক কারণে যেমন অনেক রাষ্ট্রের সাথে দরকষাকষি শুরু করতে পারে এখন। বাংলাদেশের এই অপার ভূরাজনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দূরদর্শী কূটনৈতিক পরিচয় প্রদান করে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url