ভূরাজনীতি অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ভূ-রাজনীতি অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নিয়ামকের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভূরাজনীতি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাপানিদের পুনর্জাগরণের মাধ্যমে ভূরাজনীতি তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। ভূরাজনীতি ভৌগোলিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে একটি দেশ অন্য দেশের সাথে আন্তঃরাষ্ট্রীয় শক্তির সম্পর্ক নিরূপণ, পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ ও নিজেদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে অধিষ্ঠিত করতে চায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার রাষ্ট্রের মর্যাদা বৃদ্ধির একটি অন্যতম উপাদান হলো ভূরাজনীতি। ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন বেশি হওয়ার সুবিধা পেয়ে থাকে। ভূরাজনীতিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। দিন দিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভূরাজনীতির গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভূ-রাজনীতি কি? : ইংরেজি Geo-Politics শব্দ এসেছে জার্মান শব্দ Geo-Politik শব্দ থেকে । গ্রিক শব্দ Geo এবং Politik থেকে Geopolitik শব্দের উদ্ভব। Geo অর্থ হচ্ছে ভূ আর Politik অর্থ রাষ্ট্রের সাথে জড়িত। অতএব দেখা যায় যে ভূগোল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সংযুক্ত করে ভূরাজনীতি এবং এর দ্বারা রাজনীতিক শক্তি ও ভৌগোলিক উপাদানের সমন্বয় সাধন করা হয়। ভূগোল অধ্যয়নের সেই অংশ হচ্ছে ভূরাজনীতি যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পররাষ্ট্রনীতি এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে। আবার বলা যায়, ভূরাজনীতি হচ্ছে রাজনৈতিক শক্তি (Political power). ভৌগোলিক বিন্যাস (Geosetting) এবং রাজনৈতিক ক্রিয়া (Political action) এর মধ্যকার গভীর বিশ্লেষণ। ভৌগোলিকভাবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তি অর্জন, বিকাশ ও এর সম্প্রসারণের নাম হলো ভূরাজনীতি

ভূরাজনীতি অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য 

ভূরাজনীতি অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান নির্দেশ : একটি রাষ্ট্রের জন্য ভৌগোলিক আয়তন ও অবস্থান দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বড় আয়তনের রাষ্ট্রের ভূমিকা বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয়ে ভূরাজনীতি কাজ করে। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানার জন্য ভূরাজনীতির শিক্ষা থাকা দরকার।

২. রাষ্ট্রের গঠন সম্পর্কে ধারণা : রাষ্ট্রের গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ভূরাজনীতি অধ্যয়নের মাধ্যমে কোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানবিক নির্ভর করে রাষ্ট্রের গঠনের উপর যা ভূরাজনীতিতে আলোচনা করা হয়ে থাকে।

৩. অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ : অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় বিরাজমান। উৎপাদন বাজার সৃষ্টি, যোগাযোগের মাধ্যমে আন্ত জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি ইত্যাদি বিক্রয় নির্ধারণে ভূরাজনীতির ভূমিকা অপরিসীম। সুতরাং অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে জানার জন্য ভূরাজনীতির পাঠ থাকা আবশ্যক।

৪. রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নিয়ন্ত্রণ : রাষ্ট্রের পরিচালনার নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির প্রভাব কাজ করে। কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঐসব রাষ্ট্রের সাথে কি রকম সম্পর্ক বিদ্যমান তা বিবেচনায় আনা হয়। কোনো রাষ্ট্র তার রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি নির্ধারণ করে থাকে তার ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন, প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ভিত্তি করে। তাই বলা যায়, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি প্রণয়নেও ভূরাজনীতির গুরুত্ব অপরিসীম।

৫. রাষ্ট্রের সম্পদ সম্পর্কে ধারণা : একটি দেশের অভ্যন্ত রীণ সম্পদের উপর সেদেশের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি নির্ভর করে। যে রাষ্ট্র প্রাকৃতিক সম্পদে যত বেশি সমৃদ্ধ তার ভূরাজনৈতিক শক্তি তত বেশি হয়। একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় ভূরাজনীতি অধ্যয়নের মাধ্যমে ।
৬. আঞ্চলিক ভৌগোলিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা : একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বিভিন্ন উপাদানের তারতম্যর কারণে ঐসব অঞ্চলের সংস্কৃতিও ভিন্ন ধরনের হতে পারে। আর এসব উপাদানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে আঞ্চলিক রাজনীতি। অনেক সময় সাংস্কৃতিক মিল না থাকার দরুন বিচ্ছিন্নতার দাবি আন্দোলন হয়। ঐসব আঞ্চলিক রাজনৈতিক অবস্থা জানার জন্য আমাদের ভূরাজনীতির জ্ঞান থাকা অবশ্যক।

৭. সামরিক নীতি নির্ধারণ : ভূরাজনীতি সামরিক নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে শুধু মাত্র ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

সামরিক নীতি নির্ধারণে ভূরাজনীতির ভূমিকা নিম্নরূপ :

ক. প্রতিবেশী নিয়ন্ত্রণ : বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র তার প্রভাবের মাধ্যমে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ পক্ষে এ কাজগুলো সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ভূরাজনৈতিক কারণে ভুটানের উপর ভারত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

খ. সামরিক সরঞ্জাম জোগাড় : ভূরাজনীতি সামরিক সরঞ্জাম জোগাড় করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। কোন দেশ কোন ধরনের আক্রমণের শিকার হতে পারে তার উপর ভিত্তি করে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে ।

গ. অস্ত্র প্রতিযোগিতা : ভৌগোলিক অবস্থান ভূরাজনীতির কারণে অনেক রাষ্ট্রের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। যেমন- ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অর্ধ শতাব্দীকাল যাবৎ অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকল্পে আরেকটি হলো কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ।

উপসংহার : এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা নির্ধারণে ভূরাজনীতি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। একটি দেশ ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে তখনই প্রভাব বিস্তার করতে পারে যখন সে দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা, স্বনির্ভরশীলতা ইত্যাদি বিষয়গুলো সেই রাষ্ট্রের অনুকূলে থাকে। তাই বলা যায়, ভূরাজনীতি অধ্যয়নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url