ভূরাজনীতির উদ্ভব-বিকাশ ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভূ-রাজনীতির উৎপত্তি-বিকাশধারা ও গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।
ভূ-রাজনীতির উদ্ভব ও বিকাশ : ভূরাজনীতি শব্দটি জার্মান শব্দ Geo Politik হতে এসেছে। এটি ভূগোল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাথে সম্পর্কযুক্ত। ভূরাজনীতি শব্দটি বেশি পুরনো নয়। জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভবের সাথে সাথে ভূরাজনীতির বিষয় উদ্ভব হয়েছে। কিভাবে জাতি রাষ্ট্র এলো, কিভাবে জাতি রাষ্ট্র একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলো। বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে জাতি রাষ্ট্র কিভাবে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করলো সবই ভূরাজনীতির অন্তর্ভুক্ত। এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভূরাজনীতির জন্ম। জার্মান চিন্তাবিদ ইমানুয়েল কান্ট ভূরাজনীতির জনক হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। কেই কেউ রুডলফ ডোলেনকে ভূরাজনীতির জনক বলে অভিহিত করেন। প্রাচীন কালেই ভূরাজনীতির সূত্রপাত ঘটলেও ১৬৪৮ সালের ওয়েস্ট ফেলিয়া চুক্তির মধ্য দিয়ে বিশ্ব মঞ্চে ভূরাজনীতির অভিগমন ঘটে।
বর্তমান বিশ্বে ভূরাজনীতি বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভূরাজনীতির বিষয়টি পূর্ণতা পেলেও বর্তমান সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে এটি ব্যাপক আলোচিত বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। মূলত ভূরাজনীতি হলো রাজনৈতিক উপাদান ও প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত প্রয়োগ। আবার অন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাই হলো ভূরাজনীতি। বিশ্বায়নের এই যুগে ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ভূ-রাজনীতির গুরুত্ব: ভূরাজনীতির গুরুত্ব সম্পর্কে নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. ভৌগোলিক অবস্থান : ভৌগোলিক অবস্থান যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো রাষ্ট্রের আয়তন ছোট ও স্থলবেষ্টিত হলে তার দ্বারা সে রাষ্ট্র প্রভাবিত। যেমন স্থল বেষ্টিত হওয়ার কারণে নেপালের উপর ভারত প্রভাব বিস্তার করে থাকে এবং তাদের পররাষ্ট্র নীতি ভারত কেন্দ্রিক।
২. রাষ্ট্রের গঠন সম্পর্কে ধারণা: রাষ্ট্রের গঠন সম্পর্কে ধারণা লাভ করার জন্য ভূরাজনীতির অধ্যয়ন করা আবশ্যক। ভূরাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যেতে পারে যে রাজনৈতিক, সমাজিক, অর্থনৈতিক, মানবিক বিষয়গুলো কেমন হবে তা রাষ্ট্রের গঠন কাঠামোর উপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রের গঠন কাঠামো নিয়ে ভূরাজনীতি আলোচনা করে।
৩. জলবায়ু: ভূরাজনীতির আরেকটি প্রাকৃতিক বিষয় হলো জলবায়ু। কোনো দেশের উৎপাদনশীলতা ও অর্থনৈতিক অবস্থা গড়ে ওঠে তার জলবায়ুর উপর নির্ভর করে। তাছাড়া মানুষের কর্মদক্ষতা ও স্বাস্থ্য নির্ধারিত করে সে দেশের জলবায়ুর প্রভাবে।
৪. পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে: কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে ভূরাজনীতি একটি মেরুদণ্ডের মতো হয়ে কাজ করে। কারণ মেরুদণ্ড ঠিক থাকলে যেমন সারা শরীর ঠিক থাকবে তেমনি ভূরাজনীতি ঠিক থাকলে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে সফলতা আশা করা যায়।
৫. ভূ-প্রকৃতি : ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো ভূপ্রকৃতি। ভূপ্রকৃতি পররাষ্ট্র নীতি, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, জাতীয়তাবোধ প্রভৃতির ক্ষেত্রে মূল্যবান ভূমিকা পালন করে। সাগর, নদী বা পাহাড়বেষ্টিত দেশকে অন্যদেশ সহজেই আক্রমণ করতে পারে না। তার রাষ্ট্রের ভিতর বনজঙ্গল অনন্য বা অনুন্নত যোগাযোগের কারণে জাতীয়তাবোধ হ্রাস পেতে পারে কারণ মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে ।
৬. সামরিক নীতি নির্ধারণে : সামরিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা যায় ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব একটি ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলো ভৌগোলিক কারণে আক্রমণের শিকার হয় এবং ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় অনেক দেশ।
৭. সীমান্ত সংঘাত : সীমান্ত সংঘাতের ক্ষেত্রে ভূরাজনীতি যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বিভিন্ন সময় দেখা যায় সীমান্ত নিয়ে যুদ্ধ ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়। যেমন- ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৬৫), চীন ভারত যুদ্ধ (১৯৬১), মেক্সিকো-আমেরিকা যুদ্ধ (১৮৪৬) ইত্যাদি ।
৮. অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ : অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বেশির ভাগ কাজগুলো আবর্তিত হয়। ভূরাজনীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বাজার সৃষ্টি, উৎপাদন ও যোগাযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। তাই অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে ধারণার জন্য ভূরাজনীতির গুরুত্ব অপরিসীম।
উপসংহার : সুতরাং বলা যায় যে, ভূরাজনীতি বিভিন্ন উপাদান নিয়ে সৃষ্ট এমন একটি তত্ত্ব যা দেশীয় সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের নানা রকম বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করে সঠিক পন্থা নির্ধারণে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিধারা নির্ধারণে সাম্প্রতিক সময়ে ভূরাজনীতি একটি শক্তিশালী উপাদানে পরিণত হয়েছে। তাই দিন দিন এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ভূরাজনীতির বিভিন্নমুখী প্রভাব অনেকটাই দৃশ্যমান ।