সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়েছিল? পিছনের কারণ আলোচনা কর।

প্রিয় পাঠক, আলাইকুম আশা করি আপনারা সকলে ভালো আছেন। আজকে আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে যে সকল প্রশ্নের উত্তর জানবো সেই প্রশ্নগুলো চলুন দেখে নেই, "সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণ কি?" "সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ কী?" "সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণগুলো আলোচনা কর।" "সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়েছিল? পিছনের কারণ আলোচনা কর।" এছাড়া আরও আমরা জানবো, "সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণগুলো আলোচনা কর।" এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণগুলো মূল্যায়ন কর। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণগুলো একই


সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেন ভেঙে পড়েছিল?

কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলসের ধারণার মধ্য দিয়ে উনিশ শতকে সমাজতন্ত্র বাস্তব আকার ধারণ করেছিল। ১৯১৭ সালে লেনিনের হাত ধরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপের কয়েকটি দেশে। তবে এক শতাব্দীর বেশি সময় সমাজতন্ত্র টিকে থাকেনি। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পুঁজিবাদী দেশগুলোর সাথে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ঠাণ্ডা লড়াই এর সূত্রপাত হওয়াতে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার কারণ


নিচে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণগুলো আলোচনা করা হলো :

১. রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব: সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যক্তির পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে সব স্থানেই রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। মানুষের জীবনের স্বাভাবিকতাকে বিকাশ হবার সুযোগ দেয়া হয়না। কিন্তু মানুষ স্বাধীন ও মুক্ত হয়ে থাকতে ভালবাসে। মানুষ জীবনের এই অধীনতাকে মেনে নিতে না পেরে এ শাসনব্যবস্থার বিরূপ প্রভাব পড়ে। এজন্য এ শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।

২. প্রয়োগিক দুর্বলতা : সমাজতন্ত্র শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে প্রায়োগিক দুর্বলতা। এ তত্ত্বটি বাস্তব রূপ পাওয়ার পর মাত্র এক শতাব্দী টিকে ছিল। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তরা সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক দিকগুলো জোরালোভাবে উপস্থাপন করলেও প্রায়োগিক দিকে তেমন সফলতা দেখাতে পারেননি। এজন্যই সমাজতন্ত্র এ শতাব্দী পর ভেঙে পড়ে।

৩. অসংগতিপূর্ণ: সমাজতন্ত্রে সর্বহারার যে কর্তৃত্বের কথা বলা হয়েছে তার সাথে আসলে বাস্তবতার কোন মিল নেই। শ্রমিক শ্রেণিকে সর্বহারা বলা হলেও বিষয়টি এমন নয় তাদের দখলে পূর্বে অনেক কিছু ছিল কিন্তু তা পুঁজিপতিদের জন্য ছেড়ে দেয়া হচ্ছে জোরপূর্বক বরং যারা সমাজে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির তারা কারখানার মালিকদের সাথে চুক্তি করেই শ্রমে নিয়োজিত হয়েছিল।

৪. পুঁজিবাদ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচারণা : ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো রাশিয়া থেকে সমাজতন্ত্রকে হটানোর জন্য ১৯১৭ সালের বলশোভিক বিপ্লবের পর ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশগুলো সমাজতন্ত্রকে প্রতিহত করাতে সচেষ্ট হয়ে উঠে। যার ফলে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এতে বিশ্ব দুটি দিকে ভাগ হয়ে যায়। এ দুটি দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কিভাবে নিজের মতাদর্শে নিয়ে আসা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় ইতিবাচক ও নেতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলশ্রুতিতে সমাজতন্ত্র পুঁজিপতিদের কাছে পরাজিত হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পতন হয় এবং মার্কিন মিত্ররা বিশ্ব থেকে সমাজতন্ত্রকে হটিয়ে দেয়। সমাজতন্ত্রে এই পুঁজিপতিদের ব্যাপক প্রচারণার ফলেই ক্রমশ বিদায় নেয়।

৫. গ্রহণযোগ্যহীন শ্রেণিহীন সমাজ : সমাজতন্ত্রে কেবলই গ্রহণযোগ্যহীন সমাজের কথা বলা হয়েছে। এই সমাজতন্ত্রের সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমাজের লোক একই দক্ষতার হয় না ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এখানে এমন কিছু লোক আছে যারা কোন কিছু করতে পারে না। কোন নির্দিষ্ট শ্রেণির উপর নির্দেশিত কাজ করতে পারে। সমাজতন্ত্রে যে শ্রেণিহীনতার কথা বলা হয়েছে তাদের আবার শ্রেণির মধ্যে ফিরে যাবার কথা বলা হয়েছে যা আসলে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তরা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি।

৬. মানুষ যন্ত্রতুল্য : সমাজতন্ত্রে মানুষকে যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা সমাজতন্ত্রে মানুষকে উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এ ব্যবস্থায় মানুষের মধ্যে যে সুপ্ত গুণ নিহিত রয়েছে তা বিকশিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ব্যক্তির উপর অনিচ্ছাকৃত চাপিয়ে দেয়া হয়। এ ব্যবস্থায় মানুষের যে সহজাত গুণ রয়েছে তা উপেক্ষিত হওয়ার কারণে সরকারের অপরাপর শ্রেণি বিভাগের মধ্যে গণতন্ত্র বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ফলে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে

৭. আদর্শহীন সমাজব্যবস্থা : সমাজতন্ত্রে যে আদর্শ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল তা পরবর্তীকালে অন্তঃসার শূন্য হয়ে পড়ে। এ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা, উৎপাদন, শিক্ষা, দক্ষতার উপর যে জোর দেয়া হয়েছিল তা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির সম্পূর্ণ বিরোধী বিবেচিত হয়। মানুষ নিজের প্রবৃত্তিকে কাজে লাগাতে পারে না। ফলে | মানুষের উপর একটা প্রভাব পড়ে আস্তে আস্তে সমাজতন্ত্র বিলুপ্তি ঘটে।

৮. গণতন্ত্র ও ধর্মহীনতা : এ শাসনব্যবস্থায় জনগণ কোন ধরনের সুযোগ স্বাধীনতা ভোগের সুযোগ পায় না। সুতরাং বোঝাই যায় সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের কোন উপস্থিতি নেই। এ ব্যবস্থায় জনগণের শৃঙ্খলাবদ্ধতা ভীতশ্রদ্ধ মনোভাব সৃষ্টি করে এটিও সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ার আরেকটি কারণ। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্রে পরকাল ও ধর্মেরও বিষয়টি অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা ধর্মের কোন বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করেনি। ফলে এ সমাজব্যবস্থায় পিছনে ধর্মপ্রাণ মানুষের খারাপ ধারণা জন্মে।

৯. পারস্পরিক দ্বন্দ্ব : সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পতনের জন্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বকে বেশি দায়ী করা হয় । পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো যখন সমাজতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য লেগে ছিল তখন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দূর করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় ফলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।

১০. সামরিক নীতি গ্রহণ : এ শাসনতন্ত্রে কোন রাষ্ট্রের প্রতি ঔপনিবেশিক মনোভাব পোষণ করে না। কিন্তু অতীতে যেসব দেশে সমাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল সেসব দেশে কখনো আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ এর ক্ষেত্রে সামরিক নীতি গ্রহণের কথা না থাকলেও প্রতিটি রাষ্ট্রই সামরিক দিককে পরিহার করতে সক্ষম হয়নি। রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো সামরিক দিক থেকে সর্বদাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে থাকতো। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত রাশিয়ার পতন ঘটে। আর রাশিয়ার পতনের পর সমাজতান্ত্রিক চেতনা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

১১. আমলাতন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা : সমাজতন্ত্রে আমলাতন্ত্র একটি নিষ্ক্রিয় সংগঠন হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আমলাতন্ত্র সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে পরিচালনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করলেও সমাজতন্ত্রে আমলাতন্ত্র ক্রিয়াশীল নয়।

১২. মিখাইল গর্বাবেভের নীতি : সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইলই বেশি দায়ী ছিল সমাজতন্ত্র পতনের পিছনে । তিনিই ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা খারাপ অবস্থায় পৌঁছে যায়। তিনি রাশিয়াকে বাঁচানোর জন্য একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা খোলামেলা নীতি নামে পরিচিত। সুতরাং বলা যায় মিখাইল গর্ভবেভের নীতিই বেশি দায়ী।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতিতে যে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয় তার মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের পতন ঘটে। রাশিয়ার পতনের পর পৃথিবীর কোন দেশে আর সমাজতান্ত্রিক চেতনা ধারন করে টিকে থাকতে সক্ষম হয়নি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url