বাংলাদেশের ভূ কৌশলগত গুরুত্ব আলোচনা কর।

ভূমিকা : ভৌগোলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অবস্থান মূলত দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মাঝামাঝি একটি সীমারেখায়। এদেশের তিন দিকে ভারত অবস্থিত। বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব দিকে মায়ানমারের অবস্থান। আর দক্ষিণ সীমানায় রয়েছে সুবিশাল বঙ্গোপসাগর। ভূ-রাজনীতিগত দিক থেকে ভারতের নিকট বাংলাদেশ ভূগুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 



বাংলাদেশের অবস্থানের কারণে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সাথে খুব সহজে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে না। যেহেতু ভারত সরকার সহজে এ রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষার করতে পারে না সেহেতু ঐ রাজাগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভবপর হয় না। তাই এ রাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হচ্ছে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কৌশলগত গুরুত্ব

ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ২০° ৩৪' উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৬°৩৮′ উত্তর অক্ষাংশের এবং ৮৮ ও ১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৯২°৪১′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। যার ফলে এ দেশের অবস্থান Absolute বা পরম অবস্থান নির্দেশ করে। অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশের রয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ।

বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট ASEAN, SAARC-এর মতো উদীয়মান আঞ্চলিক জোট, বর্তমান বিশ্বে আলোচিত দেশ ও Rising Country চীন এর মতো দেশ এবং দক্ষিণে বিশাল জলরাশি Bay of Bengal এর মতো অবস্থানিক প্রপঞ্চকের মধ্যে অবস্থিত যা তাকে বিদেশনীতি গ্রহণ থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছে। একটি রাষ্ট্রের পরম অবস্থান (অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাগত), সমুদ্র উপকূলবর্তী অবস্থান (Sea side location), गম্মিহিত অবস্থান, (Refative location ) সুসংহত হলে সেই রাষ্ট্রের প্রভাব বলা বেড়ে যায়, যা বাংলাদেশের অনুকূলে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রচুর সম্পদের সম্ভাবনাময় সমাকীর্ণ। বাংলাদেশের এক-দশমাংশ সার্বভৌম ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে বিস্তৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে হালকা জনসংখ্যা অধ্যুষিত অথচ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ ।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত বিভিন্ন জাতিসত্তার অসমস্বত্ব উপস্থিতি আর বর্তমান বিশ্বের দুই উদীয়মান পরাশক্তি চীন ও ভারতের বিশেষ কাছাকছি অবস্থান এবং এখান থেকে অনায়াসে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের উন্মুক্ত জলভাগে প্রবেশের সুবিধার সম্ভাব্যতা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে করে তুলেছে বিশেষ গুরুত্ববহ। 

অন্যদিকে এলাকাটির বিপুল ভূ-সম্পদ, প্রায় ব্যবহৃত পানি সম্পদ জনভারাক্রান্ত আর অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ ক্ষুদ্রায়তন বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক অপরিহার্য মূল্যবান অঙ্গে পরিণত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশি জাতির জন্য ভবিষ্যৎ সম্পদ সম্ভাবনার এক অপরিমেয় এবং অফুরন্ত ভাণ্ডার, সম্ভাবনার প্রতিশ্রুত ভাণ্ডার (Land of Promise) যেন নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতে মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম মেঘালয়, ত্রিপুরা (যা Seven Sisters নামে পরিচিত) ছাড়িয়ে প্রায় ৬৫০ কি. মি. দূরে চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তে অবস্থিত। সুতরাং Seven Sisters এর উপর সহজেই নিয়ন্ত্রণ ও যোগাযোগ রক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একই কথা বলা চলে চীনের ক্ষেত্রেও। কারণ চীন চায় Seven Sisters এ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন উসকে দিতে

এছাড়াও বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে বঙ্গোপসাগর। ভারতের জন্য বঙ্গোপসাগরে এর অংশ ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত বৃহৎ গ্যাস ক্ষেত্রে দেশের গৃহস্থালি গ্যাসের চাহিদার এক তৃতীয়াংশ পূরণ করে, যা এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) এর বিক্রয় এক তৃতীয়াংশ হ্রাস করে। 

আরো সংক্ষিপ্তভাবে ও নির্দিষ্টভাবে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ অত্যন্ত গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করেছে এবং এটি দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের যোগান দ্বিগুণ করেছে। এখানে বঙ্গোপসাগরের এই অবদান ভারতের দ্রুত উন্নয়নে সাহায্য করেছে। এটি ভারতকে এর মুদ্রা সমন্বয়ে সহযোগিতা করেছে। এ কারণেই আমরা ভারতকে একটি ক্ষমতাশীল অবস্থানের দাবি রাখতে দেখি।

অপরদিকে বঙ্গোপসাগরে স্থানিক ধারন ভারতের আন্তঃরাজনীতির ক্ষেত্রে একটি প্রভাবনীয় বিষয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৭ সালে যখন বঙ্গোপসাগরে 'মালাকর অনুশীলন' নামক নেস্ত অনুশীলন শুরু হয়েছিল সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশসমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেটি নয়া দিল্লিতে সরকার ও তাঁর বিরোধীদলের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। 

বিশ্লেষকগণ বিশ্বাস করেন যে, এ ধরনের কৌশলগত বন্ধন চীন এবং ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে ক্ষতিসাধন করবে। এভাবে ভারতের জন্য এ ধরনের 'হস্তক্ষেপ' থেকে বঙ্গোপসাগরকে রক্ষা করা একটি ব্যাপার ।

বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের আয়তন ক্ষুদ্র হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এটি বিশেষ তাৎপর্যময়। ভারতের জন্য বাংলাদেশি ভূখণ্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, বঙ্গোপসাগর ইত্যাদি বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ রয়েছে। 

বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ মৎস্য সম্পদ আহরণ করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ বাণিজ্য করে এই বঙ্গোপসাগর দিয়েই। বাংলাদেশের উচিত এইসব সম্ভাবনাময় স্থানকে উন্মুক্ত করা।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ ভূ-প্রকৃতিগত দিক দিয়ে এমন একটি বলয়ে অবস্থান করছে যার ফলে ভূ-রাজনীতিতে দিন দিন গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানই আজ বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্ব বৃদ্ধি করছে ।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url