বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো আলোচনা কর।

• বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সমস্যা 
• বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সম্ভাবনা 
• বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সম্ভাব্য ও সমস্যা
• বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সমস্যা ও সম্ভাবনাসমূহ 
• বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকসমূহ

ভূমিকা : ভূরাজনীতি বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও এর অনেক নেতিবাচক দিক রয়েছে। যে কোনো দেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান সে দেশের জন্য সবসময় আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হতে পারে যেমন- বেলজিয়ামের ভৌগোলিক অবস্থান। বেলজিয়াম সবসময় ফ্রান্স ও জার্মানির রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের তিনদিক দিয়ে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের নিরাপত্তা বলয় হলেও তা হুমকির কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা/সম্ভাবনা 

নিম্নে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা বা সম্ভাবনাসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. ভৌগোলিক অবস্থান : বাংলাদেশের জলবায়ু সমভাবাপন্ন। মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের ফলে বাংলাদেশে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর প্রভাব লক্ষ করা যায়। আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হওয়ার কারণে কৃষিকাজ ও ব্যবসায়বাণিজ্যের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে এদেশে। তাছাড়া একদিকে সমুদ্র ও অপরদিকে হিমালয় পাহাড় থাকার কারণে এদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।

২. সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল হিসেবে গুরুত্ব: বাংলাদেশ একাধারে সামুদ্রিক ও অসামুদ্রিক অঞ্চল। ফলে বাংলাদেশ উভয় সুযোগ সুবিধা লাভ করতে পারে। তিনদিকে ভারত বেষ্টিত হওয়ার কারণে এবং একদিকে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

৩. যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল : বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও বিমান ঘাঁটি স্থাপন করতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের আধিপত্য বৃদ্ধি পাবে। ফিলিপাইন তাদের চুক্তি নবায়ন না করায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য দক্ষিণ এশিয়ায় কমে গেছে। বাংলাদেশ এর বিকল্প হতে পারে।

৪. ভারতের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব : সামরিক দিক থেকে ভারতের কাছে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত শুরু থেকেই বাংলাদেশে ট্রানজিট দাবি করছে যাতে করে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহের সাথে যোগাযোগ করা সহজ হয়।

৫. চীনের কাছে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব : চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত ও বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক সমস্যা রয়েছে। তাই চীন চায় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে হাতে রাখতে এবং ভারতের উপর চাপ তৈরি করতে। এক্ষেত্রে চীনের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

৬. কৌশলগত গুরুত্ব : ভারত সবসময় বাংলাদেশকে পাশে রাখতে চায়। অন্যদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কখনো চায় না। ভারত তার চরম শক্তিতে বা আধিপত্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাক। এরজন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্র চায় যে বাংলাদেশকে হাতে রেখে ভারতকে দমিয়ে রাখতে।

৭. চীনকে দমাতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল : অর্থনৈতিক দিক থেকে চীন অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে দমাতে বাংলাদেশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে আগ্রহী।

৮. চীন-জাপান দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের ভূমিকা : চীন ও জাপানের মধ্যে অনেকদিন থেকে দ্বন্দ্ব চলছে। তাছাড়া জাপানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই চীনের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সহযোগিতা জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই চাইবে। যাতে ভিন্ন দিক দিয়ে চীনকে চাপ দেওয়া যায়। অন্যদিকে চীন অবশ্যই বাংলাদেশকে তার পাশে চাইবে।

৯. ভারতের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ : বাংলাদেশ ভারতের জন্য আলাদা একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেছে। এজন্য ভারত বাংলাদেশকে তার নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে যাতায়াত নির্ভর করে।

১০. ভারতের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব : ভারতের - কাছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক বেশি গুরুত্ব - রয়েছে। ভারত দেশবিভাগের সময় এ অঞ্চল নিজের অন্তর্ভুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। ইদানীং কলকাতার বন্দর তাদের নাব্যতা হারাচ্ছে। ফলে ভারত এখন আরো বেশি পরিমাণে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সমস্যা/ নেতিবাচক দিকগুলো

নিম্নে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

১. পশ্চাৎপদ অঞ্চল : বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। তাছাড়া এখানে পরিবেশের বিপর্যয়ও অনেক বেশি। যে কোনো মুহূর্তে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। এটা এ অঞ্চলের শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট করবে। অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এর প্রভাব বাংলাদেশের উপর মারাত্মকভাবে পড়ছে।

২. বৈশ্বক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি: বিশ্বে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। গবেষকগণ মনে করছেন, এর ফলে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা বলছেন, নিরক্ষীয় অঞ্চলে বরফ গলতে থাকলে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চল ডুবে যাবে।

৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ২০০৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশে সিডর আঘাত হানে। এতে অনেক জানমালের ক্ষতি হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ সমুদ্র উপকূলে হওয়া ঘূর্ণিঝ জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবছর অনেক ক্ষতি হয়।

৪. শরণার্থী সমস্যা: বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে বাংলাদেশের উপর শরণার্থী এর চাপ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ অনেকবার মায়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যায় পড়েছে। তাই বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো শরণার্থী সমস্যা। বাংলাদেশ ছোট দেশ কিন্তু এর জনসংখ্যা আয়তনের তুলনায় অনেক বেশি। তাই সমস্য বাংলাদেশে পরিবেশের প্রতি বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

৫. জলবায়ুর প্রভাব: বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ক্রান্তীয় জলবায়ু প্রবাহিত হয়। এখানে পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ার কারণে গড়ে বঙ্গোপসাগরে বছরে ১২টি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়, যা অনেক সময় সাইক্লোনে রূপ নেয়।

৬. পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব : বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো বাংলাদেশ ও চীনের প্রতিবেশী দেশ। চীন ও ভারত বর্তমান বিশ্বের দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। ফলে কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশকে হাতে রাখতে চাচ্ছে তাদেরকে দমানোর জন্য, যা বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।

৭. বাংলাদেশের উপর ভারতের প্রভাব : বাংলাদেশের ভূঅবস্থানগত আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো বাংলাদেশ ভারত বেষ্টিত। তিনদিক ভারত দ্বারা বেষ্টিত। ফলে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। আর সংগত কারণে ভারত বৃহৎ রাষ্ট্র হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র দেশ বা শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ তার বিরুদ্ধে যেতে পারে না।

৮. ভারতের উপর নির্ভরশীলতা : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃনদী সংযোগ রয়েছে। ভারত এসব নদীতে অধিকাংশ স্থানে বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। নদীর পানির জন্য বাংলাদেশকে পুরোপুরি ভারতের উপর নির্ভর করতে হয়।

৯. মায়ানমার ও রোহিঙ্গা সমস্যা : মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত সমস্যা ছিল। বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদালতে তা নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান হয়নি। অনেক সময় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তাছাড়া অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবৈধভাবে স্থায়ীভাবে বাস করছে।

১০. ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের ক্ষতি : ভারত ও পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবেই একে অন্যের শত্রু। এ দুটি রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের ফলে একটি নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের উপর পড়ে। বৈদেশিক বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়।

১১. চীন-ভারত দ্বন্দ্ব: ভারতের সাথে চীনের সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। চীন, ভারত দ্বন্দ্বেও বাংলাদেশ রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে কোনো সময় ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি হতে পারে। এর ফলে চীন চাইবে বাংলাদেশের সহযোগিতা অপরপক্ষে ভারতের বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করা সহজ হবে। এটা বাংলাদেশের ভূঅবস্থানের জন্য একটি নেতিবাচক দিক।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়। যে, বাংলাদেশের অবস্থান ভূ-রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো সবসময় বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের শুরু থেকেই ভারত বাংলাদেশকে তার নিরাপত্তার জন্য গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তাছাড়া বিস্তারের জন্য বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করছে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url