মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা আলোচনা করো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম। মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নানা ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার ঘটনার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তবে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়।
মুজিবনগর সরকারের মোট ১২টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ছিল। মন্ত্রণালয়গুলো বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে কাজ করেছে। নিম্নে মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অবদান আলোচনা করা হলো :
১. প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত : মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী, সেনা প্রধান ছিলেন লে. কর্নেল আবদুর রব উপসেনা প্রধান ও বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন গ্রুপ কাপ্টেন এ কে খন্দকার। মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। পরবর্তীতে তিনটি বিগ্রেডও গঠিত হয়। এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।
২. পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনা ও মিশন স্থাপন করার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সহানুভূতি ও সহযোগিতা আদায় করা এ মন্ত্রণালয়ের কাজ ছিল। এ মন্ত্রণালয় বিদেশে প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
৩. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্যসংক্রান্ত কার্যাবলি : মুজিবনগর সরকারের অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরীণ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ছিল। এ মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বাজেট প্রণয়ন ও আয়ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ, সংগৃহীত সম্পদের হিসাব প্রস্তুকরণ, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন, রাজস্ব ও শুল্ক আদায় প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করত।
৪. প্রশাসন ও সংস্থাপন সংক্রান্ত : মুজিবনগর সরকারের সাধারণ প্রশাসন বিভাগের কাজে একজন পূর্ণ সচিব নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কাজ করতেন। এ বিভাগ প্রবেশন, নিয়োগ, বদলি, পোস্টিং, শৃঙ্খলা সরকারি নিয়োগের নীতিমালা বাস্তবায়ন, মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনকারী সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর তালিকা সংরক্ষণ, নিয়োগের জন্য প্যানেল তৈরি ইত্যাদি কাজ এ মন্ত্রণালয় পালন করত।
৫. আঞ্চলিক প্রশাসন ব্যবস্থা : মুজিবনগর সরকারের ইতিহাসে আঞ্চলিক প্রশাসন সৃষ্টি একটি স্মরণীয় অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করা হয় এবং সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণাকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের আঞ্চলিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এছাড়া ১৮টি জেলায় ১৮ জন জেলা প্রশাসকও নিয়োগ করা হয়। শরণার্থী সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সামরিক বেসামরিক বিষয়াবলির সুষ্ঠু সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ ভার এই প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোর ওপর দেওয়া হয়।
৬. তথ্য ও বেতারসংক্রান্ত কার্যক্রম : মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তৎপর ভূমিকা পালন করেছিল। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র সরকারের অধীনে সংস্থাসমূহের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন খবরাখবর প্রচার করত। পাকবাহিনীর হত্যা ও অত্যাচারের কাহিনি বর্ণনা করার পাশাপাশি পাকবাহিনীকে বিদ্রূপ করে নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার বহির্বিশ্বে অবরুদ্ধ বা শরণার্থী হওয়া বাঙালি এবং দেশের মধ্যে আটকে পড়া মানুষের মনে উৎসাহের সৃষ্টি করত। মুক্তিযোদ্ধারা এ বেতারের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দারুণভাবে উৎসাহিত হতো।
৭. স্বরাষ্ট্র সম্পর্কিত কার্যাবলি : মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন এ. এইচ. এম কামরুজ্জমান । বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ ও সংশিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সেগুলো প্রেরণ করা ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। এ মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দেশের চারটি রেঞ্জের জন্য চারজন ডি আই জি এবং প্রতি জেলার জন্য একজন করে এস পি নিয়োগ করে। এ মন্ত্রণালয় অবমুক্ত জেলার প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন, ভ্রমণ ডকুমেন্ট ইস্যু করা, তদন্ত পরিচালনা করা প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করত।
৮. ত্রাণ ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত কার্যক্রম : রিলিফ কমিশনের অধীনে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ গঠন করা হয়। এ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন কামরুজামান। এ বিভাগ ত্রাণের জন্য গৃহীত বিভিন্ন প্রকার আবেদন পরীক্ষানিরীক্ষা করে বাংলাদেশি নাগরিকদের সাহায্যে করা, বাংলাদেশ শিক্ষকমণ্ডলীর রিলিফের ব্যবস্থা করা, উদ্বাস্তু শিবিরের শিশুদের উপকারার্থে শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে ক্যাম্প-স্কুলসমূহের জন্য একটি স্কিম প্রণয়ন ও আশিংকভাবে বাস্তবায়ন করা প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ বিভাগটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের অবদান অপরিসীম। মুজিবনগর সরকারের সদস্য ও দায়িত প্রাপ্ত ব্যক্তিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দূরদর্শী মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘসময় ধরে সংঘটিত হয়নি। মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল।