মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট ও কাঠামো আলোচনা কর।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ সরকারে ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এই সরকারের মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছেছিল। একদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, অপরদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে এ সরকারের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
মুজিবনগর সরকার গঠনের উদ্দেশ্য/প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ সরকার গঠন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নামে পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এই সরকারের মাধ্যমেই সঠিক গন্তব্যে পৌঁছেছিল। একদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, অপরদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে এ সরকারের ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘটনা ছিল বিশেষ তাৎপর্যবহ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আলোচনার কথা বলে কালক্ষেপণ করে এক পর্যায়ে তারা নিরস্ত্র মানুষের উপর অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয় গণহত্যা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
গ্রেফতারের প্রাক্কালে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ সময় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের অধিকাংশ নির্বাচিত সদস্য ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁদের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার কথা ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় “নতুন রাষ্ট্র নতুন জাতি জন্ম নিল” শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয় “একটি রাষ্ট্র আজ সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নিল । এ নতুন নগরে সে রাষ্ট্রের নাম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র ।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার জন্মলগ্নে আকাশে থোকা থোকা মেঘ ছিল। তার জন্মলগ্নে চারটি ছেলে প্রাণ ঢেলে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি' গানটি গাইল। তার জন্মলগ্নে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করা হলো। তার জন্মলগ্নে সহস্র কণ্ঠে জয়ধ্বনি উঠল 'জয় বাংলা'।”
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর এ সরকারকে স্বীকৃতিদান ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে পত্র পাঠানো হয়। এরপর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান ও বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানানো হয়।
মুজিবনগর সরকার গঠন
মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়। ঐ দিনই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার আদেশ এবং অনুমোদন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা। এ সরকারের প্রধান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
তারই নামানুসারে এ সরকারের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর সরকার। এ সরকার গঠিত হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায়। যার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। প্রথম দিকে মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগরে স্থাপিত হলেও পরবর্তীকালে এর সদর দপ্তর কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত হয়।
মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলেও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয় ১৭ এপ্রিল। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার (মুজিবনগর) আম্রকাননে দেশি বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিক ও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তায় শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
শপথ বাক্য পাঠ করান জাতীয় পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী। শপথ অনুষ্ঠানে প্রবাসী সরকারকে উপদেশ ও পরামর্শ প্রদানের জন্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী) মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মুজাফফর) অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিং, কংগ্রেসের শ্রীমনোরঞ্জন ধর এবং আওয়ামী লীগের এ জন প্রতিনিধি নিয়ে সর্বমোট ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়।
এ উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীসহ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন ৭ জন।
মুজিবনগর সরকারের গঠন কাঠামো
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেন। এ সময় মুজিবনগর সরকারের কাঠামো ছিল নিম্নরূপ :
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদ
রাষ্ট্রপতি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তান সামরিক শাসকদের হাতে বন্দি)
উপরাষ্ট্রপতি: সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকার বলে সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ)
প্রধানমন্ত্রী: তাজউদ্দিন আহমেদ
অর্থমন্ত্রী: এম. মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী: এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান
পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী: খন্দকার মোশতাক আহমদ
প্রধান সেনাপতি: কর্নেল (অব.) এম. এ. জি. ওসমানী, এম. এন. এ
চিফ অব স্টাফ: কর্নেল (অব.) আবদুর রব
ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং বিমান বাহিনী প্রধান: গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার
সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ দলিলপত্র : তৃতীয় খণ্ড পৃ: ১৬-১৭
উপসংহার : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের গঠন ও গঠন পরবর্তী এ সরকারের কার্যক্রম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি সোনালি অধ্যায়। কারণ এ সরকারের তৎপরতা বহির্বিশ্বকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর ধর্ষণ, নির্যাতন ও গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির প্রতি বিশ্বব্যাপী যে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতারই ফল। তাছাড়াও এ সরকারের কারণে দেশের মধ্যে যুদ্ধকালীন শৃঙ্খলা বিরাজ করছিল।