১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ও গুরুত্ব আলোচনা করো।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এ নির্বাচনের ফলাফলে পাকিস্তান ভাঙনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ ভাঙন ঠেকাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এরকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টের ফলে রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেয়। ফলে পাকিস্তান ভেঙে যায় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনি ফলাফলে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় জাতীয় পরিষদের ১৬২টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন এবং প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৭২.৫৭ ভাগ লাভ করে। বাকি ২টি আসনের মধ্যে একটিতে জয়লাভ করেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নুরুল আমীন এবং অপরটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায়। 

জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ৭টি মহিলা আসনের সবকটিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সর্বমোট ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৭টি। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের মোট ৩০০টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন লাভ করে। 

প্রদত্ত ভোটের ৮৯% আওয়ামী লীগের অনুকূলে যায়। অন্য ১২টি আসনের ৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী, ২টিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং একটিতে জামায়াতে ইসলামী জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১০টি আসনের সবকটিতে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ফলে প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের দলীয় আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৮টি।

অপরদিকে, জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৩৮টি এলাকাভিত্তিক আসনের মধ্যে ৮৩টি আসনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি জয়লাভ করে। আর প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৪২.২০ ভাগ পায়। বাকি ৫৫টি আসনের ৯টিতে মুসলিম লীগ (কাইয়ুম খান), ৭টিতে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়ে-ই-ইসলাম, ৬টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ (ওয়ালী খান), ৭টিতে জমিয়তে উলামায়ে-ই-ইসলাম, ৪টিতে জামায়াত-ই-ইসলাম, ২টিতে মুসলিম লীগ (কনভেনশন) এবং ১৩টিতে নির্দলীয় প্রার্থী জয়লাভ করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ৬টি মহিলা আসনের ৫টিতে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি এবং ১টিতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ন্যাপ (ওয়ালী খান) জয়লাভ করে। মহিলা আসনসহ পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৮টি। উক্ত পর্যালোচনায় স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং জনমত পূর্ব পাকিস্তানের দিকে একথা সুনিশ্চিত হয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং পাকিস্তান ভাঙনের প্রক্রিয়া

১৯৭০ সালের নির্বাচন বিশ্বের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে মোট ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানে কোন আসনই পায়নি। 

পক্ষান্তরে, পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও লাভ করেনি। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক আর পিপলস্ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক দলে পরিণত হয়ে জাতীয় প্রতিনিধিত্ব করার চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং পাকিস্তানকে ভাঙনের মুখে ঠেলে দেয়। এ নির্বাচনের রায়ই মূলত পাকিস্তানের মৃত্যুর প্রধান কারণ।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব

নিম্নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি লাভ করে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই বিজয়।

২. বাঙালিদের আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি : ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিতে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য জোরদার হয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালিদের আত্মবিশ্বাস শক্তিশালী করে।

৩. ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্তির চেতনা : এ নির্বাচনে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেসিক শোষণ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানিদের সত্যিকারের প্রতিনিধি তা বিশ্ববাসীর চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে বিশ্বের জনসমর্থন লাভ করা সহজতর হয়।

৪. পাকিস্তানের মৃত্যুর বার্তাবাহক : আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে একটি আসন পায়নি। অন্যদিকে, Peoples Party পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে একটিও আসন পায়নি। নির্বাচনে এ ধরনের রায় এটাই প্রমাণ করে যে, পাকিস্তানের এক অংশের জনগণ অন্য অংশকে সমর্থন করে না। এ নির্বাচনের রায়ই পাকিস্তানের মৃত্যুর কারণ ।

৫. জাতির অনৈক্যর প্রকাশ : এ নির্বাচনে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ঐক্যের কোন ভিত্তি নেই। পাকিস্তানের দু'অংশের জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষা ও মানসিকতা ভিন্নমুখী। এ সকলের মধ্যে একত্রীকরণ করা কঠিন ব্যাপার।

৬. সংগ্রামী চেতনার উদ্ভব : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতির মধ্যে সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ ঘটে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাঙালিদের স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছে।

৭. পাকিস্তানের ব্যর্থ প্রত্যাশা : এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যাশাকে ব্যর্থ করে দেয়। কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রত্যাশা করেছিল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে অন্যান্য দলের সাথে জোট করতে বাধ্য হবে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু দেখা যায় এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব এক জয়ের প্রেক্ষিতে, বাঙালি জনগণের মধ্যে একটি আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি হয় এবং তারা উপলব্ধি করে যে, এ বিজয় ছয়দফার বিজয়, এ বিজয় পশ্চিম পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির শুভ সূচনা ।

৮. ৬ দফাকে স্বীকৃতি দান : ১৯৬৬ সালে প্রণীত ৬ দফাকে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারের ঘোষণা করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যাপকভাবে ভোট প্রদানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে তাদের ন্যায্য দাবি হিসেবে গ্রহণ করেন।

৯. প্রথম সাধারণ নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল প্রাদেশিক নির্বাচন। ১৯৭০ সালে একই সাথে কেন্দ্রীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঐ নির্বাচন ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

১০. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন কোন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় এটি ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ নির্বাচন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন হয়।

১১. পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের স্বার্থ ও আশাআকাঙ্ক্ষা ভিন্নতার অভিব্যক্তি : এ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক বৃহৎপুঁজি ও সামরিক আমলাচক্রের দৌরাত্ম্যকে বাঙালি জনগণ প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের দৃষ্টিভঙ্গি স্বার্থ ও আশাআকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ পৃথক ।

১২. সংবিধান প্রণয়ন : একটি দেশ পরিচালনার জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো সংবিধান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণ করেন। কেননা, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান গঠন করা। তাই নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠনের অব্যবহিত পরই আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান প্রণয়নের কর্মসূচিতে হাত দেন। তারপর ১৯৭২ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সংবিধান বলবৎ ও কার্যকরী হয়।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের পর পাকিস্তানের দু'অংশের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতের অনৈক্য দেখা যায় এবং সকলেই বুঝতে পারে যে, পূর্ব-পশ্চিম এ দু'অংশের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা সম্ভব নয়। যার ভিত্তিতে পাকিস্তান ভাঙনের দিকে এগিয়ে যায়

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url