যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদান

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে মুজিব সরকারের সাফল্য

বাঙালি জাতির জীবনে যে অল্প কয়েকজন মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর উদাত্ত আহ্বানে একদিন জেগে উঠেছিল সমগ্র বাঙালি জাতি। ত্রিশ লক্ষ বাঙালির রক্তে রঞ্জিত এই বাংলাদেশের তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন সকল প্রেরণার উৎস। পৃথিবীর খুব কম রাজনৈতিক নেতা তাঁর মত এত ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সামরিক অফিসার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাঁর সাফল্য ছিল তুলনাবিহীন। কিন্তু তাকে হাল ধরতে হয় এমন একটি রাষ্ট্রের যার অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের হাল ধরতে গিয়ে তিনি দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের এবং তাঁর দলের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সাম্রাজ্যবাদী চরদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং তাঁর নিজ দলের একাংশের দুর্নীতিও তাকে পদে পদে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। তবুও মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকার্যের কিছু কিছু অভাবনীয় সাফল্যের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 


যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপ 

১. ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলে ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। সে সময়ে অনেকেই আশংকা প্রকাশ করেছিল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব সহজে বাংলাদেশ ত্যাগ করবে না।

২. প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর এই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

৩. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ: একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজসাধ্য নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ বিশেষ করে চীনাপন্থি মুক্তিযোদ্ধাগণ এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিসমূহ তাদের অস্ত্রশস্ত্র সরকারের নিকট জমা দেয়নি। ফলে স্বাধীনতা লাভের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ১০ দিনের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই অস্ত্রশস্ত্র জমা দেওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি ঘটে।

৪. বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্গঠন: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার অতি দ্রুত ভারতসহ বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে বিষত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তা-ঘাট, সেতু, কালভার্ট ও বিমানবন্দর পুনরায় নির্মাণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সাহায্যে চট্টগ্রাম নৌ-বন্দরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পুঁতে রাখা মাইন অপসারণ করে এই নৌবন্দরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।

৫. অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ন্ত্রণ : স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। সরকারের হাতে কোন দেশীয় ও বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ভীষণ দুর্বল। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিপুল পরিচিতি এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে। বিদেশী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ অকৃপণ হস্তে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী প্রেরণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার এসব সাহায্যসামগ্রী সময়মত সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে ১৯৭২ সালেই দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হতে পারত।

৬. জাতীয়করণ নীতি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা প্রভৃতি জাতীয়করণ করেন। এসব শিল্প-কারখানা ও ব্যাংকের অবাঙালি মালিকগণ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বেই পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় তাদের সম্পত্তি জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার জাতীয়করণ নীতি ছাড়াও ব্যক্তিগত পুঁজি বিনিয়োগের সীমা নির্ধারণ করায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

৭. সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান : আওয়ামী লীগ ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধী। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে মূল্যায়ন করা এবং রাজনৈতিক বক্তব্য রাখাকে তিনি বরাবরই ঘৃণা করতেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটানোর জন্য তিনি তাই রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সংযোজন করেন যা বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই সমাদৃত হয়।

৮. জোট নিরপেক্ষ নীতি : বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্ব থেকেই আওয়ামী লীগ জোট নিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বভাবসিদ্ধ তেজোদীপ্ত কণ্ঠে সম্মেলনে উপস্থিত সকলের নিকট জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার এবং কাজে ও কথায় এর নীতি অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ জানান।

৯. সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বড় সাফল্য ছিল ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান। জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবার পূর্বেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করে দেশে ও বিদেশে গণতন্ত্রকামী মানুষের নিকট তিনি শ্রদ্ধা অর্জন করেন।

১০. সংবিধান প্রণয়ন: বজাবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম ও স্বায়ী অবদান হচ্ছে জাতির জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন। যেখানে পাকিস্তান সরকার ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘ ৯ বছরেও দেশকে একটি সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছিল, সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার মাত্র ১০ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন করে সমগ্র বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছিল। সংবিধান প্রণয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। অনেক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে আজও এ সংবিধান কার্যকর রয়েছে।

১১. শিক্ষা সংস্কার : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী ও গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কিন্তু এই কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের পূর্বেই তাকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তবে তিনি মৃত্যুর পূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয় কালাকানুন বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য নতুন আইন জারি করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই আইনের সুফল এখন ভোগ করছে।

১২. ভূমি সংস্কার : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত সমস্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। যাদের ১০০ বিঘার বেশি জমি আছে সেই বেশি জমি এবং নতুন চর বিনামূল্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার বিধান করা হয়। গ্রাম বাংলার ঋণ জর্জরিত কৃষকদের ঋণ মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগ সরকার 'খাইখালাসী আইন' পাস করে। এই আইন প্রণয়নের ফলে হাজার হাজার দরিদ্র কৃষক জোতদারের নিকট থেকে তাদের জমি ফেরত পায়। এই “খাইখালাসী আইনে" নিয়ম করা হয় যে, যদি কেউ বন্ধকী ও চুক্তি কবলা জমি ৭ বছর ভোগ করে তাহলে তার পরের বছর থেকে সেই জমি মূল মালিক অর্থাৎ বন্ধকদাতা ফেরত পাবে।

১৩. পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড : গ্রাম বাংলায় আজ আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ-এর ব্যবহার দেখতে পাই। গ্রামের কৃষক ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানার মালিকরা এখন পল্লী বিদ্যুতায়নের সুযোগ ভোগ করছেন। এর সবটুকু কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকারের। এই সরকারই সর্বপ্রথম গ্রাম বাংলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য 'পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গঠন করেছিল।

১৪. পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অতি দ্রুত সাফল্য লাভ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বের শতাধিক রাষ্ট্র এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের সাথে চুক্তির ফলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল বাংলাদেশ লাভ করে এবং ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী ৪৪ হাজার কিউসেক পানি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কোন সরকারই এত বেশি পরিমাণ পানি আনয়ন করতে পারেনি।

সুতরাং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, দেশী-বিদেশী চক্রান্ত, অতি বাম ও স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও অসামান্য সাফল্য অর্জন করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url