একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ভূ-রাজনীতির ভূমিকা
ভূমিকা : বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের মধ্যেই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কারণ প্রতিটি রাষ্ট্রই কোনো না কোনোভাবে অপরের উপর নির্ভরশীল। যে পদ্ধতি বা নীতির মাধ্যমে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে পররাষ্ট্রনীতি বলা হয়। পররাষ্ট্রনীতি আবার কতকগুলো উপাদান দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। ভূ-রাজনীতি এর অন্যতম নীতি নির্ধারক। তাই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ভূ রাজনীতির ভূমিকা অপরিসীম।
পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ভূ-রাজনীতির ভূমিকা
যে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভূ-রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাই ভূ-রাজনীতির ভূমিকা বর্ণনাতীত। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ভৌগোলিক অবস্থান : কোনো দেশের বৈদেশিক বা পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র যে সকল সুবিধা অসুবিধার সম্মুখীন হয়, জলবেষ্টিত রাষ্ট্র বিপরীতমুখী সমস্যা মোকাবিলা করে। তবে স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করে। যেমন- নেপাল, ভুটান।
২. জলবায়ু : ভূ-রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জলবায়ু। জলবায়ু কোনো একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে। পররাষ্ট্রনীতিও নির্ধারিত হয় জলবায়ু দ্বারা। কারণ নিরক্ষীয় অঞ্চল এবং মেরু অঞ্চলের পররাষ্ট্রনীতি কখনো এক হয় না। তাছাড়া কোনো এলাকার মানুষের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. জীবনযাত্রার মান : কোনো দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে সে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সামাজিক অবস্থা। কারণ আর্থসামাজিক অবস্থা ভালো হলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।p
৪. প্রাকৃতিক পরিবেশ : আমাদের জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভূমিকা অপরিসীম। প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা মানুষের আচরণ ও প্রকৃতি প্রভাবিত হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতার ফলে আচরণে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন- শীতপ্রধান অঞ্চল এবং উষ্ণমণ্ডলীয় মানুষের আচরণ সম্পূর্ণ আলাদা।
৫. সরকার পদ্ধতি : পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরকার পদ্ধতি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক। উন্নয়নের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করে। সরকার পদ্ধতি অনেকাংশে পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে ।
৬. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য : ভৌগোলিক পরিবেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। ভৌগোলিক অবস্থানের উপর বাণিজ্য কাঠামো অনেকটা নির্ভরশীল। বাণিজ্যের সুবিধা লাভের জন্য অনেক দেশ জোট ও নেত্রীজোট গঠন করে যা পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে।
৭. ভূমির উর্বরতা : অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অনেকাংশে ভূমির উর্বরতার উপর নির্ভর করে। ভূমির উর্বরতা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ বেশি সুবিধা লাভ করে থাকে। তাই ভূমির উর্বরতা ভূ-রাজনীতির এক অন্যতম উপাদান। ভূমির প্রকৃতি, জমির উর্বরতা পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে।
৮. ভূ-প্রকৃতি : ভূ-রাজনীতির একটি অনবদ্য উপাদান ভূ প্রকৃতি। কোনো রাষ্ট্র নদী, পাহাড়, বন, উপত্যকা, সাগর দ্বারা বেষ্টিত হলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। ফলে সে দেশ অনেক সুবিধা লাভ করে। অন্যদিকে যেসব রাষ্ট্রের বনভূমি, জলাভূমি কম তারা নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। ভূ-প্রকৃতি পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে।
৯. অভিন্ন সংস্কৃতি : অভিন্ন সংস্কৃতি একটি রাষ্ট্রের জাতীয়তাবোধ তৈরিতে ভূমিকা রাখে। কারণ কোনো দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, জীবনধারা সে দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল একটি দেশকে অন্যদেশের প্রভাবের আওতায় নিয়ে যায়।
১০. আকার, আয়তন ও জনসংখ্যা : কোনো দেশের আকার, আয়তন, জনসংখ্যা সে দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। কারণ এগুলোর উপর ভিত্তি করে একটি দেশের শক্তি নির্ধারিত হয়। যেমন- রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের আকার, আয়তন বৃহৎ এবং জনবহুল। তাই তারা শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে।
১১. জাতীয় সংহতি ও জাতীয়তাবোধ : কোনো দেশের সংহতি ভালো হলে, ঐ দেশের পররাষ্ট্রনীতি সুদৃঢ় হয়। একই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠী যেকোনো দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। জাতীয় সংহতি ও জাতীয়তাবোধ পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক।
১২. প্রতিবেশী : প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বৃহৎ হলে, সে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। ফলে ক্ষুদ্ররাষ্ট্র বৃহৎ রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
১৩. প্রাকৃতিক সম্পদ : ভূ-রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের উপর পররাষ্ট্রনীতি নির্ভর করে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হলে পররাষ্ট্রনীতি শক্তিশালী হয়। পররাষ্ট্রনীতির উপর ভিত্তি করে প্রাকৃতিক সম্পদ দুইভাগে বিভক্ত। যেমন- তেল ও খাদ্য। মধ্যপ্রাচ্য জ্বালানি সমৃদ্ধ হওয়ায় ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি।
১৪. খাদ্যশস্য : খাদ্যশস্য উৎপাদনের উপর পররাষ্ট্রনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। যেসব দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সে সব দেশের পররাষ্ট্রনীতি তাদের অনুকূলে থাকে।
১৫. খনিজ সম্পদ : ভূ-রাজনীতিতে খনিজ সম্পদের ভূমিকা অধিক। কারণ, খনিজ সম্পদ এর একটি উপাদান। যে কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি খনিজ সম্পদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। কারণ, খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলো পুরো বিশ্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে তারা স্বাধীন।
১৬. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা : একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা ভূ-রাজনীতির উপর নির্ভর করে টিকে থাকে। রাজনৈতিকভাবে যেসব রাষ্ট্র স্থিতিশীল তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন তত বেশি। আর এই স্থিতিশীলতা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
১৭. সামগ্রিক অবকাঠামো : একটি দেশের উন্নয়ন সামগ্রিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল। অবকাঠামোগত দিক থেকে উন্নত দেশ তাদের সুবিধামতো পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে পারে। তাছাড়া প্রাকৃতিক অবকাঠামোও পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি, কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে ভূ-রাজনীতির ভূমিকা বর্ণনাতীত। ভূ-রাজনীতির বিষয়গুলো পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। ভু-রাজনীতির কারণেই কোনো কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি শক্তিশালী, আবার কোনটির দুর্বল শুধু পররাষ্ট্রনীতি নয়, অর্থনৈতিক ও সামরিক অবস্থানও ভূ-রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। বিখ্যাত ফরাসি সমরনায়ক নেপোলিয়ন বলেছিলেন পররাষ্ট্রনীতি সে দেশের ভূগোল দ্বারা নির্ধারিত।"