বাকশাল কি? বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্য কি?

বাংলাদেশ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক আদেশবলে 'বাকশাল' নামে একটি জাতীয় দল গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি একীভূত হয়ে 'বাকশাল' গঠিত হয়।



বাকশাল কি 

'বাকশাল' এর পূর্ণরূপ হলো 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ' বা (Bangladesh Krishak Sramik Awami League BAKSAL) ১৯৭৫ সালের ৬ জুন এক আদেশবলে বাকশালের গঠনতন্ত্র ঘোষণা এবং নবগঠিত সংগঠনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গঠন পদ্ধতি সম্পর্কে বিধান করা হয়। এবং বাকশালের চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে এবং সম্পাদক হন এম মনসুর আলী।

বাকশাল গঠনের উদ্দেশ্য কি?

'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের' (বাকশাল) গঠনতন্ত্রে বলা হয় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র, এই চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বাস্তবায়ন, বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি বিধান, মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান, সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপসাধন, সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ বিশেষ করে কৃষক ও শ্রমিকসহ মেহনতী ও অনগ্রসর জনগণের উপর শোষণের অবসানের জন্য পূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন, মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আশ্রয় প্রভৃতি মৌলিক সমস্যা সমাধান করে বাংলাদেশে এক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই হবে এই দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সকল প্রচেষ্টার সহযোগিতা প্রদানের দৃঢ় অঙ্গীকার এবং সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত মুক্তি সংগ্রামের প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করা হয়।

জেলা গভর্নর নিয়োগ: 'বাকশাল' নামক জাতীয় দল গঠনের পর '৭৫ সালের ১৯ জুন এই নবগঠিত দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভায় এক নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, বাংলাদেশের মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তরিত করে ৬০টি জেলা গঠন করা হবে। প্রত্যেক জেলায় একজন গভর্নর নিয়োগ করা হবে। প্রত্যেক জেলা প্রশাসনিক পরিষদ থাকবে এবং জেলা গভর্নর এই প্রশাসনিক পরিষদের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন। জেলা গভর্নরদের নামও ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয় যে, ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর হতে এই ব্যবস্থা কার্যকরী হবে।

বাকশালের মূল্যায়ন

বাকশালের মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন কাজ। কেননা পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীতে চাকরিরত ও বিভিন্ন অভিযোগে চাকরিচ্যুত একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে নিহত হন। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের তথা বাকশালের পতন ঘটে। এজন্যই রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন যে, বাকশালের মূল্যায়ন করার মত সুযোগ খুবই সীমিত। কেননা এই ব্যবস্থা কার্যকরই হয়নি। তবুও বিশ্লেষকগণ বাকশাল গঠন এবং একদলীয় ব্যবস্যা প্রবর্তনকে নিম্নোক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করেছেন।

১. অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন : বাকশাল গঠনের ফলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। এর ফলে গণতন্ত্রমনা জনগণের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আপসহীন নেতৃত্ব প্রদানের জন্য। সুতরাং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক একদলীয় শাসন বা বাকশাল গঠনকে গণতন্ত্রকামী মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।

২. দ্রুত নতুন সম্ভাবনাময় ব্যবস্থার জন্য দেওয়ার ব্যর্থতা : বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বরাবরই দুর্বল ও আশাবাদী ছিলেন। চতুর্থ সংশোধনী আইন ও একদলীয় ব্যবস্থা যদি অতি দ্রুত কোন সম্ভাবনাময় ব্যবস্থার জন্ম দিতে সক্ষম হত, তাহলে বাঙালি জনগণ এই ব্যবস্থাকে মেনে নিত।

৩. গুণগত পরিবর্তন হয়নি: বিশ্লেষকদের মতে, বাকশালের প্রবর্তন প্রকৃতপক্ষে কোন গুণগত পরিবর্তন আনেনি। আওয়ামী লীগের হর্তা-কর্তারাই মূলত বাকশালের হর্তাকর্তা হন এবং মন্ত্রিসভার পুরাতন সদস্যরাই বাকশালের কর্মকর্তা কিংবা মন্ত্রিসভার সদস্য হন।

8. চীনাপন্থীদের অভিযোগ : ১৯৭৩ সালে 'ত্রিদলীয় গণঐক্যজোট' গঠিত হওয়ায় চীনাপন্থি দলগুলো বঙ্গবন্ধু মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে। তারা আশঙ্কা করে যে, বাকশাল গঠিত হয়েছে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বরং তাদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য। ফলে চীনাপন্থিগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিরোধী জনমত তৈরি করতে সচেষ্ট হয়। পক্ষান্তরে তা রুশ-ভারত বিরোধী মনোভাবে রূপান্তরিত হয় এবং 'বাকশাল' সম্পর্কে মানুষের মনে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি করে।

৫. ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ : বাকশাল গঠন বা একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে গিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। স্বাধীন মতামত প্রকাশে বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়। এর ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতাকামী মানুষ বাকশাল ব্যবস্থার প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে।

৬. রাষ্ট্র ও দলকে এক করে দেখা: চতুর্থ সংশোধনীর পর সৃষ্ট একদলীয় ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও দলের মধ্যে পার্থক্য হ্রাস করে। বরং বলা যায় 'রাষ্ট্র ও দল' এক হয়ে যায়। রাষ্ট্রপ্রধান দলের চেয়ারম্যান হওয়ায় মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া দলীয় গঠনতন্ত্রে বলা হয় যে, যিনি বাকশালের সদস্য, শুধুমাত্র তিনিই জাতীয় সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। এর ফলে ক্ষমতাসীন একমাত্র রাজনৈতিক দলের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও কেন্দ্ৰীভূত হয়। ড. সৈয়দ সিরাজুল ইসলামের মতে, "প্রকৃত অর্থে মুজিব রাষ্ট্রীয় ঐক্যকে দলীয় ঐক্যের সাথে এক করে দেখেন।

একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমালোচিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তবে একথা অবশ্য সত্য যে, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোকে অক্ষুণ্ণ রাখা এবং জাতীয় সংহতি রক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন। যদি তিনি সময় পেতেন তা হলে হয়তো বাকশালের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূর্ণতা পেত। কিন্তু পরিকল্পনার পর্যায়ে বা প্রাথমিক পর্যায়েই বাকশালের পতন ঘটে। কাজেই এই ব্যবস্থার মূল্যায়ন করাত অনেকটা অসম্ভব।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url