১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর।

বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপরিষদ ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম অধিবেশনে মিলিত হয়। এই অধিবেশনে গণপরিষদ ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি 'সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এই কমিটি বিভিন্ন বৈঠকে মিলিত হয়ে তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর গণপরিষদে উত্থাপন করে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধান গৃহীত হয়। এই সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।


১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ 

১. লিখিত সংবিধান : 

বাংলাদেশ সংবিধান লিখিত। ১৫৩টি অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট ৮২ পৃষ্ঠার এই সংবিধান ১১টি ভাগে বিভক্ত এবং এর একটি প্রস্তাবনাসহ ৪টি তফসিল ছিল। সংবিধানে বলা হয় যে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "আমার সোনার বাংলা' কবিতার দশ চরণ জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। 

জাতীয় পতাকার প্রতীক হল “সবুজ ক্ষেত্রের উপর স্থাপিত রক্তবর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত।" জাতীয় প্রতীক হচ্ছে "উত্তর পার্শ্বে ধান্যশীষবেষ্টিত পানিতে ভাসমান শাপলা ফুল, শীর্ষদেশে পাটগাছের তিনটি পরস্পর সংযুক্ত পাতা আর উভয় পাশে দুটি করে তারকা। বাংলাদেশের রাজধানী হল ঢাকা।

২. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান: 

বাংলাদেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়। তবে সংবিধান সংশোধন খুব কঠিন ব্যাপার নয়। সাধারণত সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সংবিধানে প্রযোজনীয় সংশোধনী প্রস্তাব পাস করানো যায়।

৩. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: 

বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই মূলনীতিগুলো আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য না হলেও এবং এগুলো আইনের মর্যাদা ভোগ না করলেও রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সময় এসব মূলনীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবান্বিত হতেন।

৪. মৌলিক অধিকার: 

এই সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সুতরাং সংবিধানে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করায় এগুলোর গুরুত্বও বৃদ্ধি পায়। জীবনধারণের অধিকার, চলাফেরার অধিকার, বাকস্বাধীনতার অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, ধর্ম চর্চার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি মৌলিক অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত হয়।

৫. এককেন্দ্রিক শাসন: 

সংবিধানে বাংলাদেশকে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারই সব ক্ষমতার অধিকারী। কেন্দ্রীয় আইনসভাই সার্বভৌম আইন প্রণয়নকারী সংস্থা।

৬. প্রজাতন্ত্র: 

বাংলাদেশ একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রপতি হবেন রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর নামে রাষ্ট্রের শাসন কাজ পরিচালিত হবে। রাষ্ট্রপ্রধান জাতীয় সংসদের সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।

৭. সাংবিধানিক প্রাধান্য: 

সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে ঘোষণা করা হয় যে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে ঐসব ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। যদি কোন আইন এ সংবিধানের সাথে সামঞ্জসাহীন হয় তাহলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততটুকু বাতিল হবে।

৮. সংসদীয় গণতন্ত্র: 

বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার হাতে দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ভার অর্পণ করা হয়। জাতীয় সংসদ ছিল সমস্ত ক্ষমতার উৎস। মন্ত্রিসভার সদস্যগণ একক এবং যৌথভাবে জাতীয় সংসদের নিকট দায়ী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শমত কাজ করতেন।

৯. ন্যায়পাল: 

সংবিধানে 'ন্যায়পালের (Ombudsman) পদ সৃষ্টি করা হয়। সংবিধানে বলা হয় যে, “সংসদ আইনের মাধ্যমে ন্যায়পাল সৃষ্টি করবেন। ন্যায়পাল সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের মতো ক্ষমতার অধিকারী হবেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের যেকোন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শুনবেন ও প্রয়োজনে দণ্ডাজ্ঞা দিতে পারবেন এবং যে-কোন কর্তৃপক্ষকে তাঁর নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারবেন।"

১০. সর্বজনীন ভোটাধিকার: 

সংবিধানে সর্বজনীন প্রান্তবয়স্কের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ১৮ বছর বয়স্ক যেকোন নাগরিক ভোটাধিকার লাভ করেন।

১১. মালিকানার নীতি: 

বাংলাদেশ সংবিধানে তিন ধরনের মালিকানার কথা বলা হয়েছে-- রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তিগত। সমবায় ও ব্যক্তিগত মালিকানা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে।

১২. জনগণের সার্বভৌমত্ব: 

সংবিধানে বলা হয়েছে যে, "জনগণই সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস। জনগণ প্রত্যক্ষভাবে বা প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনা করবে।

১৩. এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: 

বাংলাদেশ সংবিধানে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করা হয়। আইনসভার নাম 'জাতীয় সংসদ'। ৩০০ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং তাদের দ্বারা ১০ বছরের জন্য নির্বাচিত ১৫ জন মহিলা নিয়ে (মোট ৩১৫ জন) জাতীয় সংসদ গঠিত হবে।

১৪. অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার: 

বাংলাদেশের সংবিধানে 'সমাজ' প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও 'শ্রেণীসংগ্রাম' বা 'বিপ্লবের কথা স্বীকার করা হয়নি। বাংলাদেশ সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে জাতীয় সংসদ প্রয়োজনবোধে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি জাতীয়করণ করতে পারত। 

১৫. দলীয় শৃঙ্খলা: 

দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এই সংবিধান কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। কোন সংসদ সদস্য নিজের দল ত্যাগ করলে বা সংসদে উক্ত দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করলে তার আসন শূন্য হবে বলে বিধান করা হয়।

১৬. প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল: 

সাধারণ বিচার বিভাগ ছাড়াও সংবিধানে ট্রাইব্যুনাল গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম এর এখতিয়ারভুক্ত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url