বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ৬ দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ছয়-দফা কর্মসূচির তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ১৯৬৬ সালের ছয়দফা কর্মসূচির গুরুত্ব সম্পর্কে লিখ ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছয়দফা কর্মসূচির গুরুত্ব ও তাৎপর্য
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্কুরোদগম হিসেবে ছয়দফা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ছয়দফাভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংগঠিত হয়েছে এবং এর চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নিয়েছে এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। নিচে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছয়দফা কর্মসূচির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ‘ছয়দফা' অর্থনৈতিক অবস্থার যথার্থ বর্ণনা : ছয়দফাতে পাকিস্তানকে ভাঙতে চাওয়া হয় নি, বরং গড়তে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তানের আয়ের বৃহদাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো। দেশের সমুদয় সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানির হাতে কুক্ষিগত ছিল। বস্তুত আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি যথার্থ বর্ণনা ।
২. ‘ছয়দফা” বাংলার জনগণের বাঁচার দাবি : ছয়দফা ছিল সমগ্র বাংলার জনগণের বাঁচার দাবি। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে ছয়দফার দাবি দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র প্রচারিত হয়। পাকিস্তানি সরকার ভীত, সন্ত্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মীদের গ্রেফতার করে। এর প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।এ বিক্ষোভকে বানচাল করার জন্য পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মীদের নামে আগরতলা মামলা দায়ের করে।
৩. 'ছয়দফা' জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায় : ছয়দফা দাবি পূর্ব বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার 'মূর্ত প্রতীক' বাংলার জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটাবার ক্ষেত্রে ছয়দফার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এর গুরুত্ব বা প্রভাব সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বলেছিলেন, “ছয়দফা বাংলার কৃষক-মজুর-মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ এবং বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি।”
৪. ‘ছয়দফা' স্বাধীনতার অঙ্কুরিত বীজ : ক্ষমতাসীন সরকারের নানা রকম টালবাহানা ও নির্যাতন উপেক্ষা করে জনমত ক্রমেই ছয়দফার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। ক্রমাগত সরকারি চক্রান্তের ফলে এবং পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যা ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবি, ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে তা স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। আর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয় শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
৫. ছয়দফা কর্মসূচি মূল্যায়ন : পাকিস্তানে আইয়ুব শাসন আমলে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের মধ্যে যে স্বাধীনতার চেতনা উদ্ভব হয় সেই পটভূমিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লাহোর কনভেনশানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐ ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন। আইয়ুব সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকে প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠোর। জেনারেল আইয়ুব ছয়দফাকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী,' 'বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী', 'ধ্বংসাত্মক', বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি বলে আখ্যায়িত করেন এবং এ কর্মসূচির প্রবক্তা বঙ্গবন্ধুকে 'পাকিস্তানের এক নম্বর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে ছয়দফাপন্থিদের দমনে 'অস্ত্রের ভাষা' প্রয়োগের হুমকি দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও এর কর্ণধার বঙ্গবন্ধু আইয়ুব সরকারের হুমকিতে দমে যাবার পাত্র নন। এ কর্মসূচি সমগ্র বাঙালির চেতনা মূলে বিস্ফোরণ ঘটায়।
৬. স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সনদ : পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। এ প্রস্তাবে পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করলে পূর্ব বাংলার জনগণ এটিকে তাদের মুক্তি ও প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সনদ হিসেবে গ্রহণ করে এবং প্রকৃত স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৭. আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ : আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় আন্দোলন শুরু করার উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি পেশ করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের শাসনভার অর্পিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতাদের উপর। পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়েছিল তা অচিরেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগের কমতি ছিল না। ফলে ৬ দফা ঘোষণার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ তাদের অভাব-অভিযোগ সরকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করার সুযোগ লাভ করে। তাই ৬ দফা ছিল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ ।
৮. আন্দোলনমুখী জনমত গঠন : ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন এবং জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। একদিকে সামরিক সরকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর চালায় হয়রানি ও নির্যাতন। ১৯৬২ সালে রাজনৈতিক দলের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। এ সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (National Democratic Front-NDF) গঠিত হয়। এ জোট কিছুকাল আইয়ুব তৎপরতা চালালেও হোসেন শহীদ সোহরাওয়র্দীর মৃত্যুর ফলে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে জনমতকে সংগঠিত করে সংগ্রামী চেতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। ব্যাপক লোকের সমর্থন ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে ৬ দফা হয়ে উঠে গণমানুষের আন্দোলন। ৬ দফা জনগণের মধ্যে সংগ্রামী মনোভাব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৯. অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি : পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব বাংলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর দ্বারা বিভিন্নভাবে অবহেলার শিকার হয়। বঞ্চিত করা হয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকার থেকে। ৬ দফা দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে বাংলার জনগণের কাঙ্ক্ষিত অধিকারগুলোই মূর্ত হয়ে উঠে। ফলে বাংলার সাধারণ মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার জনগণকে পরাধীন করে রেখে ছিল তার থেকে প্রকৃত মুক্তি লাভের দলিল ছিল ৬ দফা। ফলে এর মাধ্যমে বাঙালিরা পূর্বের তুলনায় তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে
১০. বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধকরণ : শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে শুধু ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে বসে থাকেননি। তিনি ৬ দফাকে গণআন্দোলনে পরিণত করতেও সচেষ্ট হন ১৯৬৬ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এ তিন মাস শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি সারা বাংলায় ঘুরে বেড়ান। তারা ৬ দফার পক্ষে ব্যাপক জনমত সংগঠিত করতে সক্ষম হন। সরকারের দমন নিপীড়ন উপেক্ষা করে সাধারণ জনগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৬ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এভাবে ৬ দফা যে ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি করে তা বাংলার জনগণকে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফরমে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক হয়।
১১. স্বাধীনতার চেতনা সৃষ্টি : ৬ দফা ছিল একটি স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন। পূর্ববাংলাকে পশ্চিমা শাসন শোষণ এবং বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এ আন্দোলনের সূচনা ঘটে। কিন্তু ৬ দফা আন্দোলনকে দমন করার জন্য আইয়ুব সরকার যেভাবে দমন-পীড়ন চালায় তার ফলে এতদঞ্চলের মানুষের মনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তা কালক্রমে তাদেরকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। বস্তুত ৬ দফা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়সমূহ যথা ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০ এর নির্বাচন পরস্পরসূত্রে অথিত হয়ে স্বাধীনতার রূপ পরিগ্রহ। তাই বলা যায়, স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই সৃষ্টি হয় স্বাধীনতার চেতনা।
১২. উনসত্তরের গণআন্দোলনে ভূমিকা পালন : ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে এক মহা গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ৬ দফা আন্দোলন উক্ত গণঅভ্যুত্থানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ ৬ দফা আন্দোলনের সূত্র ধরেই ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বাঙালি সামরিক বেসামরিক ব্যক্তিদেরকে আসামি করে আগরতলা মামলা করা হয়। যার জের ধরেই সংঘটিত হয় ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। মূলত গণঅভ্যুত্থানের চালিকা শক্তি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফা দাবি। ৬ দফা দাবিই পরবর্তীতে ৬৯-এর গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
১৩. ১৯৭০ এর নির্বাচনে জয় লাভ : ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ক্ষমতায় আরোহণ করেন আরেক সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান। জনগণের প্রচণ্ড দাবির মুখে তিনি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইস্যু ছিল ৬ দফা। তারা জনগণের কাছে ৬ দফার ভিত্তিতে গণরায় লাভ করে ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে ৬ দফা আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ব্রিটিশ গণতন্ত্রের ইতিহাসে যেমন 'ম্যাগনা কার্টা' তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ৬ দফার অবদান। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীকার ওবায়দুল হকের ভাষায়, '৬ দফা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রিম জন্ম সনদ'। ৬ দফা আন্দোলনের পথ বেয়েই জন্ম নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।