বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী

বাংলাদেশের সাংবিধানিক অগ্রগতির ইতিহাসে যাদশ সংশোধনী আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রপতির পদটিই ছিল মুখ্য। ৮, ৭, ও ৫ দলীয় ঐক্যজোট, ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী ও প্রগতিশীল সংস্কৃতি কর্মীদের দ্বারা সৃষ্ট গণ-আন্দোলনের চাপে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল (অব.) এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করেন। 


১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল সংসদের ভেতরে ও বাইরে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আওয়ামী লীগ ১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে সংসদীয় সরকার প্রবর্তন ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে পূর্বপদে ফিরে যাবার পথ সুগম করার জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপনের নোটিস প্রদান করেন। এ সময়ে সরকার পদ্ধতির প্রশ্নে বি.এন.পি. রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার পক্ষে থাকলেও জনমতের প্রতি লক্ষ রেখে বেগম খালেদা জিয়া অবশেষে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। 

১৯৯১ সালের ২ জুলাই তৎকালীন আইনমন্ত্রী মীর্জা গোলাম হাফিজ সংবিধান সংশোধন বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে এক হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল গৃহীত হয়। ১৬ এই বিশের প্রায় ৩০৭টি ভোট পড়ে। বিপক্ষে কোন ভোটা পড়েনি। তারপর রাষ্ট্রপতি এই বিলের উপর গণভোট আয়োজন করেন। এভাবে ১০ আগস্ট তা আইনে পরিণত হয়। ফলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।

দ্বাদশ সংশোধনী আইনের ধারাসমূহ

বাংলাদেশ সংবিধানের স্বাদশ সংশোধনী আইনের ধারাসমূহ নিম্নরূপ:

১. জনপ্রতিনিধিদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ

বাংলাদেশ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের "প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে" শব্দগুলো সন্নিবেশিত হয়।

২. রাষ্ট্রপতি সম্পর্কিত

দ্বাদশ সংশোধনী আইনের সংবিধানের চতুর্থ ভাগের ১ম ও ২য় পরিচ্ছেদ' সংশোধন করে বলা হয় যে,

(ক) বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং তিনি জাতীয় সংসদ সদস্যদের যারা নির্বাচিত হবেন।

(খ) রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির উর্ধ্বে স্থান লাভ করবেন। কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত তাঁর সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। এই সংশোধনী দ্বারা প্রধানমন্ত্রীকে সকল নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। ফলে রাষ্ট্রপ্রধান নিয়মতান্ত্রিক শাসক প্রধান বা নামমাত্র শাসকে পরিণত হন।

(গ) সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে তার পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন এবং রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি বীয় পদে বহাল থাকবেন। একাদিক্রমে হোক বা না হোক দুই মেয়াদের অধিক রাষ্ট্রপতির পদে কোন বাক্তি অধিষ্ঠিত থাকবেন না।

(ঘ) স্পীকারের উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে রাষ্ট্রপতি স্বীয় পদত্যাগ করতে পারবেন। কোন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতিরূপে তাঁর কার্যভার গ্রহণের দিনে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।

(ঙ) সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে জাতীয় সংসদ সদস্যদের অন্যূন দুই- তৃতীয়াংশ ভোটে অভিশংসিত করে অপসারণ করা যাবে।

৩. উপ-রাষ্ট্রপতি পদ বিলোপ সম্পর্কিত

সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (১৫২ অনুচ্ছেদের সংশোধন) আইন দ্বারা উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত হয়। দ্বাদশ সংশোধনী আইনে বিধান করা হয় যে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে বা কোন কারণে রাষ্ট্রপতি তাঁর দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে জাতীয় সংসদের স্পীকার অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।

৪. প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা সম্পর্কিত

(ক) যে সংসদ সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন হবেন রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। তবে সংসদীয় রীতি অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন।

(খ) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে বাছাই করবেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শরুমে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদেরকে নিয়োগদান করবেন

(গ) মন্ত্রিসভা যৌথভাবে জাতীয় সংসদের নিকট দায়ী থাকবে।

(ঘ) মন্ত্রিসভার মোট সদস্যের অন্যূন নয়-দশমাংশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ সদস্য হবার যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিয়োগ করা যাবে।

(ঙ) জাতীয় সংসদ সদস্য নন এমন মন্ত্রিগণ সংসদের কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করতে পারলেও সংসদে ভোটদান। করতে এবং তাঁর মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিষয় ব্যতীত অন্য বিষয়ে বক্তব্য রাখতে পারবেন না।।

(চ) প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদি তিনি কোন সময় রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগ পত্র প্রদান করেন। অথবা তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন। জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন কিংবা সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দান করবেন। প্রধানমন্ত্রী এরূপ পরামর্শ প্রদান করবে এবং রাষ্ট্রপতি যদি এ মর্মে উপলব্ধি করেন বা সন্তুষ্ট হন যে অন্য কোন সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নন, তাহলে সংসদ ভেঙে নিবেন। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি উক্ত দায়িত্ব পালন করবেন।

(ছ) প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদি (১) তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে নিজের পদত্যাগপত্র পেশ করেন, (২) যদি তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন (৫৬ অনুচ্ছেদের ২ দফার শর্তাধীন মনোনীত মন্ত্রী ব্যতীত), (৩) যদি প্রধানমন্ত্রী যে কোন সময় যে কোন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেন এবং উক্ত মন্ত্রী উক্ত অনুরোধ পালনে অসমর্থ হন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটানোর জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দান করতে পারবেন। (৪) যদি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন বা স্বীয়পদে বহাল না থাকেন তাহলে মন্ত্রিগণ প্রত্যেকে পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে। তবে তাদের উত্তরাধিকারিগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাঁরা স্ব স্ব পদে বহাল থাকবে।

৫. উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ বিলোপ

দ্বাদশ সংশোধনী আইন দ্বারা উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ বিলোপ ঘোষণা করা হয়।

৬. জাতীয় সংসদ সম্পর্কিত

(ক) সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের সংশোধন করে বলা হয় যে, জাতীয় সংসদের অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের মধ্যে ষাট দিনের অতিরিক্ত বিরতি থাকবে না।

(খ) সংবিধানের ১৪৫ক অনুচ্ছেদের' সংশোধন করে বলা হয় যে, বিদেশের সাথে সম্পাদিত চুক্তি জাতীয় সংসদে পেশ করতে হবে, "তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোন চুক্তি কেবল সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হবে।”

(গ) সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন ও প্রতিস্থাপন করে বলা হয় যে, কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি উক্ত দল থেকে পদত্যাগ করেন। অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে। সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত থাকা এবং সংসদের কোন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকা নিজ দলের বিপক্ষে ভোটদান বলে গণ্য হবে।

(ঘ) কোন রাজনৈতিক দলের সংসদীয় নেতৃত্ব সম্পর্কে যদি কোন প্রশ্ন ওঠে তাহলে সংসদে সেই দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের নেতৃত্বে দাবিদার কোন সদস্য কর্তৃক লিখিতভাবে অবহিত হবার সাতদিনের মধ্যে স্বীকার উক্ত দলের সকল সংসদ সদস্যের সভা আহ্বান করে বিভক্ত ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের দ্বারা উক্ত দলের সংসদীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করবেন। কোন সংসদ সদস্য নির্ধারিত সংসদীয় নেতৃত্বের নির্দেশ অমান্য করলে ধরে নিতে হবে যে, তিনি তাঁর দলের পক্ষে ভোটদান করেছেন এবং সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।

(ঙ) যদি কোন ব্যক্তি নির্দলীয় প্রার্থীরূপে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে কোন রাজনৈতিক দলে যোগদান করেন তাহলে তিনি উক্ত দলের মনোনীত প্রার্থীরূপে সংসদ সদ্য নির্বাচিত হয়েছেন বলে গণ্য হবে এবং তাকে উক্ত দলের সংসদীয় নেতার নির্দেশ মেনে চলতে হবে।

৭. গণভোট সম্পর্কিত 

সংবিধানের ৮, ৪৮, ৫৬ ও ১৪২ অনুচ্ছেদ সম্পর্কিত কোন সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি তা 'গণভোটে পেশ করবেন।

৮. স্থানীয় শাসন সম্পর্কিত

দ্বাদশ সংশোধনীতে ৫৯ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, "আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হবে। ৬০ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, জাতীয় সংসদ স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করেন।"

শেষকথা 

বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। এই সংশোধনী বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করে। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, দ্বাদশ সংশোধনী বাংলাদেশের ভাগ্য বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর 

১. বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর বিষয়বস্তু কি ছিল? 

উত্তর: বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর বিষয়বস্তু ছিল সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন।

২. বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী কত সালে গৃহীত হয়? 

উত্তর: বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী ১৯৯১ সালে গৃহীত হয়। 

৩. সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী কি?

উত্তর: ১৯৯১ সালের ৬ আগস্টের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়। সংশোধনীটি উত্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ৩০৭-০ ভোটে বিলটি পাস হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url