পরীক্ষণ পদ্ধতি কাকে বলে? পরীক্ষণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
• পরীক্ষণ পদ্ধতির সংজ্ঞা দাও। পরীক্ষণ পদ্ধতির বিশেষ দিকগুলো আলোচনা কর।
• মনোবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করতে পরীক্ষণ পদ্ধতির অবদান ব্যাখ্যা কর।
বিজ্ঞান হিসেবে মনোবিজ্ঞান বিকাশে পরীক্ষণ পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সকল বৈশিষ্ট্যই পরীক্ষণ পদ্ধতি বিদ্যমান। যেমন-প্রায়োগিক সংজ্ঞা, ব্যক্তি নিরপেক্ষতা, নিয়ন্ত্রণ, পুনরাবৃত্তি, যথার্থ প্রধান প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যসমূহ পরীক্ষণ পদ্ধতির পরীক্ষণে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে বিজ্ঞানী সুসামঞ্জস্যভাবে এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষণ পাত্রের উপর উদ্দীপক-উপস্থাপন করে প্রতিক্রিয়ার পরিমাণ নির্ণয় করে থাকেন। এ পদ্ধতির পরীক্ষণে বিজ্ঞানীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকে।
পরীক্ষণ পদ্ধতি কাকে বলে
পরীক্ষণ পদ্ধতি বলতে আমরা এমন পদ্ধতিকে বুঝি যার সাহায্যে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্ভরশীল চল প্রয়োগ করে নির্ভরশীল চল বা প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করা যায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : পরীক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে কয়েকজন মনোবিজ্ঞানীর মতামত নিম্নে দেওয়া হলো-
Barry.F. Anderson (১৯৯৬) বলেন, “পরীক্ষণ হলো এমন একটি পরিবেশ যেখানে কেহ দুটি চলের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের, জন্য একটির মধ্যে পরিবর্তন এনে দেখতে পারেন। এর ফলে অন্যটির পরিবর্তন সংঘটিত হয় কিনা।”
Wayne Weiten (১৯৮৯) বলেন, “পরীক্ষণ হলো এমন একটি গবেষণা পদ্ধতি যেখানে অনুসন্ধানকারী সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে একটি চল প্রয়োগ করেন এবং দ্বিতীয় চলে ফলাফল হিসেবে কোনো পরিবর্তন হয় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করেন।”
William Buskist এবং David. W. Gerbing (১৯৯০) বলেন, “পরীক্ষণ হলো একটি গবেষণা পদ্ধতি যেখানে গবেষক কতকগুলো চল প্রয়োগ করেন এবং অন্যান্য চলের উপর তার কার্যকারিতা পরিমাপ করেন।”
পরীক্ষণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ
নিম্নে পরীক্ষণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো--
উডওয়ার্থ এবং শ্লোজবার্গ (১৯৫৪) পরীক্ষণ পদ্ধতির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। যথা-
- (ক) পরীক্ষণীয় পর্যবেক্ষণ ঘটনাটি যখন খুশি তখনই সৃষ্টি করতে পারেন। সুতরাং প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি প্রস্তুত।
- (খ) তিনি একই রকম অবস্থা যতবার খুশি পুনরুৎপাদন করে ফলাফল যাচাই করতে পারেন।
- (গ) তিনি কতকগুলো পরিবর্তন বা হ্রাস-বৃদ্ধি করে ফলাফলের পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারেন।
সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে পরীক্ষণ পদ্ধতির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ ফুটে উঠেঃ
১. পুনরাবৃত্তি : পুনরাবৃত্তি পরীক্ষণ পদ্ধতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য পরীক্ষণ পদ্ধতিতে কোনো একটি বিষয়ের উপর বার বার পরীক্ষণ পরিচালনা করা সম্ভব। যেমন-গোলযোগপূর্ণ পরিবেশ শিক্ষণের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে । এ পরীক্ষণটির পুনরাবৃত্তি সম্ভব ।
২. ইচ্ছামত চলের পরিবর্তন : পরীক্ষণ পদ্ধতির আর একটি বেশিষ্ট্য হচ্ছে ইচ্ছামত চলের পরিবর্তন সাধন। এ পদ্ধতিতে গবেষক ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় কোনো একটি বিশেষ অনির্ভরশীল চলের সৃষ্টি বলে দেখতে পারেন। তা নির্ভরশীল চলের উপর কিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। যেমন-পরীক্ষক যদি জানতে আগ্রহী হ্রদ যে শিক্ষণ পরিস্থিতিতে প্রাণীকে পুরস্কৃত করলে তার শিক্ষণ দ্রুত সংঘটিত হয় কিনা এখানে পুরস্কার প্রদান করা হলো অনির্ভরশীল চল এবং শিক্ষণের পরিমাণ হলো নির্ভরশীল চল ।
৩. নির্ভরযোগ্যতা : পরীক্ষণ পদ্ধতির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্ভরযোগ্যতা। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নিয়ম-নীতি অনুসরণে এ পদ্ধতির পরীক্ষণ পদ্ধতি পরিচালিত হয় ফলে এর ফলাফল অধিক হয়ে থাকে। কোনো কোনো ঘটনার উপর বার বার পরিচালনা করে যদি একই ফলাফল পাওয়া যায় তা হলে বলা যাবে যে এ পরীক্ষণের নির্ভরযোগ্যতা আছে ।
৪. চলের সংজ্ঞা : চলের সংজ্ঞা প্রদান পরীক্ষণ পদ্ধতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পরীক্ষণ পরিচালনা করার পূর্বে পরীক্ষণ চলসমূহের সংজ্ঞা প্রদান করে থাকেন। কি ধরনের অনির্ভরশীল চল প্রয়োগ করবেন এবং কিভাবে নির্ভরশীল চল পরিমাপ করবেন এ সম্বন্ধে তাকে স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন বর্ণনা প্রদান করতে হবে।
৫. চলের নিয়ন্ত্রণ : একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে কোনো একটি আচরণ নানা রকম ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। এর ফলে বলা মুশকিল হয়ে উঠে যে, এ আচরণটির একটি ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন ঘটনার নিয়ন্ত্রণ বা চলের নিয়ন্ত্রণ। চল নিয়ন্ত্রণের অর্থ পরীক্ষণের নির্ভরশীল চল যেন অনির্ভরশীল চল দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে সে জন্য নিয়ন্ত্রণ কৌশল প্রয়োগ করা ।
৬. পরিসংখ্যানগত পরিমাপ : পরীক্ষণ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত উপাত্তের উপর পরিসংখ্যানের বিভিন্ন পরিমাপ প্রয়োগ করা যায়। যেমন- গড়, মধ্যমা, প্রচুরক, গড় বিচ্যুতি, আদর্শ বিচ্যুতি, প্রভৃতি অংকের সাহায্যে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ করা যায় ।
৭. বস্তুনিষ্ঠতা : পরীক্ষণ পদ্ধতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বস্তুনিষ্ঠতা। এ পদ্ধতিতে গবেষক বস্তুনিষ্ঠতা গবেষণা কার্য- পরিচালনা করেন। এখানে গবেষকেরা ইচ্ছা অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের স্থান নেই।
৮. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ : মনোবিজ্ঞানে ব্যবহৃত অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় পরীক্ষণ পদ্ধতি অধিকতর বিজ্ঞান নির্ভর । বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নিয়মকানুন পরীক্ষণ পদ্ধতিতে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় ।
৯. সম্বন্ধ নির্ণয় : পরীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে মানসিক প্রক্রিয়া ও দেহগত প্রক্রিয়ার মধ্যে পরিমাণগত সম্বন্ধ নির্ণয় করা যায়।
১০. যথার্থতা : পরীক্ষণ পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যথার্থতা। বিজ্ঞানীগণ বারবার পরীক্ষণ করে ফলাফলের সত্যতা যাচাই করে দেখতে পারেন। ফলাফলের সত্যতা যাচাই পরীক্ষণ পদ্ধতির এবং গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার : উপরের বর্ণনা দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কোনো পদ্ধতির প্রধান অবলম্বনই হলো নির্ভরযোগ্য গবেষণা পদ্ধতি । পরীক্ষণ পদ্ধতি এ শর্ত পূরণ করে। এই জন্যই পরীক্ষণ পদ্ধতি শ্রেষ্ঠতম পদ্ধতি। এ পদ্ধতির কারণেই আজ মনোবিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।