প্লেটোর ন্যায় তত্ত্ব কি? প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব কি? প্লেটোর ন্যায়তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো লিখ।

প্লেটোর ন্যায়ধর্ম বলতে কী বুঝ? প্লেটোর ন্যায়বিচারের বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী?

ভূমিকা : প্লেটো ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। এ সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিক অধঃপতন এথেন্সকে বেঁধে ফেলে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে প্লেটো রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। এ উপলব্ধি থেকেই তিনি তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘The Republic’ রচনা করেন। এই গ্রন্থের একটি বিকল্প নাম আছে, “Treatise Concerning Justice.” এ বিকল্প নাম থেকেই বুঝা যায় যে, ন্যায়বিচারের প্রকৃতি, সঠিক ধারণা এবং তার সঠিক অবস্থান নির্ণয় করাই “The Republic” গ্রন্থের মৌলিক বিচার্য বিষয়। অধ্যাপক সেবাইন বলেছেন, “ন্যায়ধর্মের ধারণার মাধ্যমেই রিপাবলিকের বিভিন্ন মতবাদ চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে।”

প্লেটোর ন্যায়তত্ত্ব বা ন্যায়ধর্ম কি?

সাধারণভাবে প্রতিটি ব্যক্তির যা প্রাপ্য তাকে তা দেয়ার নামই হচ্ছে ন্যায়বিচার বা ন্যায়ধর্ম। প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ন্যায়বিচার বা ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন । তাঁর মতে, সমাজের প্রত্যেক শ্রেণি যদি নিজ নিজ কাজ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে, তাহলে ন্যায়বিচার বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে। তিনি আরো বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তি নির্দিষ্ট কাজ করে গেলে এবং তার প্রাপ্য পেলে যে কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে তা নয়, সমাজও বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা পাবে। প্লেটো ন্যায়ধর্মকে কল্পনা করেছেন সুস্থদেহে সুন্দর মনরূপে। একটি সৎ ও প্রকৃত জীবন কেবল রাষ্ট্রীয় সমাজেই সম্ভব। প্লেটোর ন্যায়বিচারের ধারণা কৃত্রিম বা বাহ্যিক কিছু নয়। তা মানব প্রকৃতির মধ্যে নিহিত মানব আত্মারই স্বরূপ। তাঁর মতে, ন্যায়বিচার হলো মানব আত্মার যথাযথ শর্ত এবং তা অন্তর্মুখী। 

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক বার্কার (Prof. Barker) উল্লেখ করেন, “প্লেটোর ন্যায় বিচারকে অন্তর্মুখী সহজাত গুণ বলে মনে করা হয় এবং এর যথাযথ উপলব্ধি মানুষের অন্তরস্থ মানবিক সত্তার উপর নির্ভরশীল।” 

প্লেটোর ন্যায়বিচার সম্পর্কে অধ্যাপক সেবাইন বলেছেন, “Justice is the bond which holds a society together, a harmonious union of individuals each of whom has natural fitness and training.” 

প্লেটোর মতে, “ন্যায়বিচারের ভিত্তি হচ্ছে যুক্তি ও প্রচলিত রীতিনীতি।” সমাজে যদি কোন ব্যক্তি অন্যায় কাজ করে বা অন্যের প্রতি অবিচার করে এবং অন্যরা তাকে অনুসরণ করতে চায়, তাহলে ন্যায়বিচারের বিলুপ্তি ঘটবে। প্লেটোর মতে, একটি ব্যক্তির জীবনকে আমরা তখনই ন্যায়পরায়ণ বলব যখন আমরা দেখব যে, তার জীবনে প্রজ্ঞা, বিক্রম, প্রবৃত্তি এ তিনটি উপাদানের সুষ্ঠু সমন্বয় ও সঠিক বিন্যাস ঘটেছে; তবে রাষ্ট্রের জীবনেও তাই হবে। এ সমন্বয় ও বিন্যাসের কিছুমাত্র এদিক ওদিক হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।

প্লেটোর ন্যায়তত্ত্ব বৈশিষ্ট্যসমুহ

প্লেটোর ন্যায়বিচারতত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে যে বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. ব্যক্তি ও রাষ্ট্র অবিচ্ছেদ্য : প্লেটো তাঁর ন্যায়বিচার সম্পর্কিত তত্ত্বে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য করেন নি। তাঁর মতে, ব্যক্তি রাষ্ট্রেরই অঙ্গ বা ক্ষুদ্র সংস্করণ মাত্র। ব্যক্তি হলো জগৎ, আর রাষ্ট্র হলো বৃহৎ জগৎ ।

২. সামাজিক বন্ধন : ন্যায়বিচার হলো এমন একটি সামাজিক বন্ধন যা সমাজের মানুষদের সুসংহতভাবে বাঁচার পথ দেখায় এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে ।

৩. সমাজে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা : তৎকালীন এথেন্সের অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যজনক অবস্থাকে স্থিতিশীল করার জন্য প্লেটো এক আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচালনা করেন। তাঁর এই আদর্শ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যই ছিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা ।

৪. যোগ্যতার স্বীকৃতি দান : ন্যায়ধর্ম এমন একটি বিধান যা সমাজের প্রত্যেকের শিক্ষা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে তার নির্দিষ্ট স্থান, কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দেয়। তারা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করলেই সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

৫. চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশ : ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্যক্তি জীবনে যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়; তার ফলে ব্যক্তির চারিত্রিক বিকাশ ব্যাহত না হয়ে বরং পূর্ণতা পায় ।

৬. ন্যায়বিচার একটি শিল্পকৌশল : প্লেটোর ন্যায়বিচার একটি শিল্প কৌশল । তিনি মনে করেন যে, শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে যেমন কোন শিল্পের উৎকর্ষ সাধন করা যায়, তেমনি ন্যায়বিচারেরও উৎকর্ষ সাধন করা সম্ভব।

৭. প্রত্যেকে দায়িত্ববান ও স্বাধীন : প্লেটো তাঁর ন্যায়বিচারের ধারণায় রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব কাজে মনোযোগ দেয়ার প্রশ্নে জোর দিয়েছেন। একজনের কাজে অন্যের হস্তক্ষেপ নীতি বিরূদ্ধ এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্বার্থপরতা ও অজ্ঞানতার স্থলে সৎজীবন ও সমাজগঠনের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধকরণের মহিমা প্লেটোর ন্যায়পরায়ণতার মধ্যে নিহিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মন প্রথমে ব্যাধিমুক্ত করা প্রয়োজন। প্লেটোর ন্যায়তত্ত্ব যদিও নঞর্থক দিক থেকে শুরু তথাপি এর গুরুত্ব অপরিসীম।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url