চল বলতে কি বুঝ? চলের প্রকারভেদ সংক্ষেপে বর্ণনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের যুগ। কোনো বিষয়ে জানতে হলে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই জানতে হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যে পরীক্ষণ পদ্ধতি সবচেয়ে উন্নত ও নির্ভরযোগ্য। পরীক্ষণ পদ্ধতি আবার কতকগুলো উপাদানের সমষ্টি। এসব উপাদানের মধ্যে চল‌ অন্যতম। চলের বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে কার্যকরীর সফল পরীক্ষণ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সে করণেই পরীক্ষণের জন্য চলের কৌশলগত ব্যবহার বা একটি পূর্ণাঙ্গ নকশা মেনে চলে তা পরীক্ষণের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।

চল কাকে বলে 

চল একটি বৈজ্ঞানিক শব্দ। যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Variable। Variable এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো চলনশীল বা পরিবর্তনশীল। সাধারণ অর্থে চল বলতে এমন একটা বৈশিষ্ট্য বা গুণ বুঝায় যা একই পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো একটি পরীক্ষণে অনেকগুলো গুণাবলি বা বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ হতে পারে। অতএব চল বলতে আমরা বুঝি যে কোনো উপাদান যা আচরণের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাই চল। সংক্ষেপে বলা যায় যা কিছু পরিবর্তনশীল বা যাকে পরিবর্তন করা যায় তাকে চল বা ভেদ্য বলে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে চলকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেগুলো নিচে দেয়া হলো।

রডিজার, রাস্টন, কেপালডি এবং অন্যান্যরা বলেন, “চল শব্দটি দ্বারা কতকগুলো বৈশিষ্ট্যকে বোঝায় যাকে পরিমাপ করা যায় বা পরিচালনা করা যায়।”

জন.সি. রাচ. বলেন, “বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর যেকোনো পরিমাপযোগ্য বিষয় যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় তাকে চল বলে।”

ম্যাকগ্লুইগান বলেন, “চল হচ্ছে এমন এক বৈশিষ্ট্য বা গুণ যা মানের সংখ্যাগতভাবে প্রকাশ ঘটায়।"

পোস্টম্যান ইগেন বলেন, "চল হলো এমন একটি বৈশিষ্ট্য বা গুণ যাকে অসংখ্য মূল্যবোধ থেকে গ্রহণ করা হয়।”

সুতরাং বলা যায় যে, যা পরিবর্তনশীল ও যাকে পরিবর্তন করা যায় তাকে চল বলে ।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কোনো পরীক্ষণ পরিচালনার মাধ্যমে যদি আমরা দেখতে চাই যে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বেশি তাপমাত্রার কোনো প্রভাব রয়েছে কিনা। এটা দেখার জন্য বেশি তাপমাত্রা ও কম তাপমাত্রার পরিবেশ সৃষ্টি করে এ দুই পরিবেশে পরীক্ষক দল ছাত্রকে সমস্যা সমাধানে ছাত্রদের ভুল গণনা করা যেতে পারে। এই ভুলের সংখ্যা এগুলোকে চল বলা হয়ে থাকে। কারণ ভুলগুলোর মূল্যমান পরিবর্তনশীল। মনোবিজ্ঞানীগণ যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার সাথে সম্পর্ক যুক্ত পরিবর্তনশীল বস্তু বা উপাদানই কেবল চল হিসাবে বিবেচ্য। সব পরিবর্তনশীল বস্তুকে অনেক সময় চল বলা যায় না। বলা যায় যে মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় ব্যবহৃত কোনো বিষয় যা কোনো কিছু যা কিছু পরিবর্তনশীল করা যায় তাকে চল বলে ।

উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিশেষ করে পরীক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে চল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চলের বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে কার্যকরী ও পরীক্ষণ পরিচালনা সম্ভব নয়। সেজন্য চলের ব্যবহার অন্যতম একটি দিক। তাহলে চল সম্পর্কিত জ্ঞান থাকা আবশ্যক। মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো চল বা ভেদ্য।

চলের প্রকারভেদ/ শ্রেণিবিভাগ 

এই পৃথিবীতে সবকিছু পরিবর্তনশীল। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এ সমস্ত পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য উপাদান এবং আচরণই চল। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিশেষ করে পরীক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে চল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রকার চল ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিটা চলই পরীক্ষণের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একটি পরীক্ষণে অনেকগুলো গুনাবলী বা বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ হতে পারে। চল বলতে আমরা বুঝি যে কোনো উপাদান, যা আচরণেরর উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে তাকেই চল বা ভেদ্য বলে। পরীক্ষণ মনোবিজ্ঞানে চার ধরনের চল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ চলকে চারভাগে ভাগ করা যায়। নিম্নে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো যথা-

১. অনির্ভরশীল বা নিরপেক্ষ চল: পরীক্ষণকারী পরীক্ষণ পাত্রের ওপর যে চলের প্রভাব লক্ষ করেন তাই হলো অনির্ভরশীল বা নিরপেক্ষ চল‌‌। আবার বলা যায় যে চল আচরণের ওপর প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে নিজেই সক্ষম এবং কারো ওপর নির্ভরশীল নয় তাই অনির্ভরশীল চল। এটা উদ্দীপক চল নামেও পরিচিত।

ওয়াইনী ওয়াইটেন বলেন, এটি অনির্ভরশীল চল হলো এমন একটি শর্ত বা ঘটনা যা একজন পরীক্ষণকারী পরিবর্তন করে অন্য চলের ওপর এর প্রভাব লক্ষ্য করেন। কোনো গবেষণায় একটি অনির্ভরশীল চলের প্রভাব নিরুপণ করার জন্য পরীক্ষক পরীক্ষণপাত্রদের দুই ভাগে ভাগ করেন। যথা-

(ক) পরীক্ষণ দল: পরীক্ষণপাত্র সেসব দল নিয়ে গঠিত যারা অনির্ভরশীল চলের নিরিখে কিছু বিশেষ ব্যবস্থা পেয়ে থাকে।
(খ) নিয়ন্ত্রিত দল: পরীক্ষণ দল যে সুযোগ পেয়ে থাকে নিয়ন্ত্রিত দল তা পায় না।

২. নির্ভরশীল চল : অনির্ভরশীল চলের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাণীর আচরণে যে পরিবর্তন ঘটে সেসব চলকে নির্ভরশীল চল বলে। অর্থাৎ যে চলকে তার উপস্থিতি বা সৃষ্টির জন্য অন্য কারোর ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে নির্ভরশীল চল বলে। এটিকে সাপেক্ষ বা আপেক্ষী চলও বলা হয়।

ওয়াইনী ওয়াইটেন বলেন, নির্ভরশীল চল হলো সেই চল যা অনির্ভরশীল চল প্রয়োগের ফলে প্রভাবিত হয় মনে করা হয়। নির্ভরশীল চল হলো অনির্ভরশীল চল কর্তৃক সৃষ্ট প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় জীবের প্রতিক্রিয়া বা সাড়াই হলো নির্ভরশীল চল। নির্ভরশীল চল সব সময় পরীক্ষণপাত্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ যে চলকে তার উপস্থিতি অনুপস্থিতি হ্রাস বা বৃদ্ধির জন্য নিরপেক্ষ চলের উপর নির্ভর করতে হয় তাকে নির্ভরশীল চল বলে ।

মধ্যবর্তী চল: যে চল নিরপেক্ষ চল ও নির্ভরশীল চলের মধ্যে সংযোগ বা সম্পর্ক স্থাপন করে তাকে মধ্যবর্তী চল বলে । অন্যভাবে বলা যায় ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যে চলের উদ্ভব হয় তাকে মধ্যবর্তী চল বলে। এটা অন্তবর্তী বা জৈবিক নামেও পরিচিত। যেমন-বয়স, লিঙ্গ, অভ্যাস, অভিজ্ঞতা প্রেষণা ইত্যাদি মধ্যবর্তী চল ।

যেমন একটি পড়া যত বেশি পড়বে তত বেশি মুখস্থ হবে। পড়াটি মুখস্থ করার পরিমাণ নির্ভর করছে কতবার পড়াই রিড়িং পড়েছে তার উপর। এই পড়াটি মুখস্থ করতে ৬০ বছরের বৃদ্ধের মুখস্থ করতে যে সময় লাগবে ২৫ বছরের যুবকের সে সময় নাও লাগতে পারে। এখানে বয়স হলো মধ্যবর্তী চল। আবার লিঙ্গভেদে মুখস্থ করার তারতম্য ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে লিঙ্গ মধ্যবর্তী চল।

বাহ্যিক চল : একটি পরীক্ষণ অনেকগুলো চল প্রাণীর আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে কিন্তু মনোবিজ্ঞানী এসব চল সম্বন্ধে আগ্রহী নন। পরীক্ষণের ফলাফলের ওপর যেসব চল অবাঞ্ছিতভাবে প্রভাব বিস্তার করে সেসব চলকে বাহ্যিক চল বলে। অর্থাৎ বাহ্যিক পরিবেশ থেকে যেসব চলের উদ্ভব হয় তাকে বাহ্যিক চল বলে । এ চলগুলো পরীক্ষক কর্তৃক আরোপিত নয় অথচ ঘটনাক্রমে পরীক্ষণের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়ে এবং আচরণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে সেসব চলকে বাহ্যিক চল বলে। যেমন তাপমাত্রা,গোলামাল,মিছিলের শ্লোগান ইত্যাদি হলো বাহ্যিক চল। পরীক্ষণ পাত্রকে কোনো কিছু মুখস্থ করতে দিলে বাহিরের মিছিলের শব্দ যদি প্রভাব বিস্তার করে তা হলে তাকে বাহ্যিক চল বলে ।

উপসংহার: উপরের আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বিশেষ করে পরীক্ষক পদ্ধতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে চল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চলের বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে কার্যকরী ও পরীক্ষণ পরিচালনা সম্ভব নয়। মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে ভালভাবে জানতে হলে চল সম্পর্কিত জ্ঞান অপরিহার্য। মনোবিজ্ঞানের সব ধরনের পরিস্থিতিতে চলের উপস্থিতি খুব দরকার।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url